- 7
- 0
এদিকে লন্ডন থেকে খ্রীশ্চান মিশনারীদের একটি জাহাজ এসে পৌঁছোয় ব্রিটিশদের কলকাতা বন্দরে। উদ্দেশ্য খ্রীষ্টধর্ম প্রচার। ব্রিটিশরা কলকাতাকে নিজেদের মতো করে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে প্রায় ১০০ বছর ধরে। নবাব সিরাজ পুরো শহরটাকে প্রায় তাসের ঘরের মতো ভেঙে ফেলার পরেও যত্ন করে আবার তার রূপ ফিরিয়েছে তারা। ততদিনে লন্ডনের পরে কলকাতাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় শহর। কিন্তু ধর্মপ্রচারের মতো একটা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে তখনো উদারপন্থী হন নি ব্রিটিশ লাটবাহাদুর। তাই স্বদেশীয় হলেও মিশনারীদের কাজের জন্য জায়গা হল না কলকাতায়। নিয়মকানুনের গেরোয় পুরো শহরটা তখন জর্জরিত। অগত্যা উপায় নেই। কলকাতার পরেই বাংলার দ্বিতীয় ইউরোপীয়ান শহর ফ্রেডরিক্সনগর বা শ্রীরামপুর। মিশনারীদের চোখ পড়লো সেখানেই। কলকাতা থেকে মিশনারীদের নৌকা শ্রীরামপুর বন্দরে এসে নোঙর ফেললো। ড্যানিশ কোম্পানিও অভ্যর্থনা করে স্বাগত জানালেন জশূয়া মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ডের মতো মিশনারীদের। তখনই শ্রীরামপুরের মাটিতে পা রাখলেন দেশবরেণ্য উইলিয়াম কেরী সাহেবও। বাংলা ও বাঙালী তাঁর অবদান কোনোদিন ভুলবে না। ড্যানিশ শহরে আসার পরে তাঁরা প্রথমেই গভর্নর সাহেব 'ও বাই'কে তাঁর বাড়িতে গিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে এলেন। বড় সাহেবও তাঁদের সাথে কথা বলে পরম তৃপ্ত। একটা ছোট ঘরে ভাড়ায় তাঁদের নির্বিঘ্নে থাকবার বন্দোবস্তও করে দিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য কেরী, মার্শম্যান সমেত অন্যান্য মিশনারীরা গঙ্গার একেবারে তীরে ৬০০০ টাকায় একটি বাড়ি কিনে থাকতে শুরু করেন। যদিও গভর্নর সাহেবের সাহায্য ছাড়া এটুকুও সম্ভব হতো না। এভাবেই শ্রীরামপুরের মাটি থেকে শুরু হয় বাংলার নবজাগরণের একটা নতুন অধ্যায়। কিছু বছরের মধ্যেই যা নতুন ঝড় হয়ে আছড়ে পড়ে বাংলার প্রতিটা ঘরে। সেই ঝড়ের দামাল হাওয়ায় আমরাও ধীরে ধীরে উড়বো, ভাসবো। শ্রীরামপুর বাংলার ইতিহাসে একটা এমনই ঝড়ের নাম, যার অভিঘাতে নিজেকে মেলে ধরে আমরা প্রত্যক্ষ করব একটা সময়কে, একটা যুগের সন্ধিক্ষণকে।
ইতিমধ্যে ভূমধ্যসাগরের ওপাশে ঘটে অঘটন। ইউরোপে ইংরেজদের নৌবহর তাদের সামরিক শক্তি নিয়ে কোপেনহেগেন আক্রমণ করে বসে। ইংল্যান্ড আর সুইডেনের যৌথবাহিনীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ডেনমার্ক ও সুইডেন। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশ। সুদূর ইউরোপে যুদ্ধের প্রভাব সরাসরি এসে পড়ে বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্রেও। ঘটনাচক্রে দ্বন্ধে জড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশ কলকাতা ও ড্যানিশ শ্রীরামপুর। ক্ষমতাবলে শ্রীরামপুর অধিকার করে নেন গভর্নরের নেতৃত্বাধীন কলকাতার ইংরেজ কাউন্সিল। নিজেদের হাতে গড়ে তোলা শহরেরই রাশ হাত থেকে বেরিয়ে যায় ড্যানিশদের। নিজের জায়গাতেই পরবাসী হয়ে পড়েন কোম্পানির বিভিন্ন পদমর্যাদায় থাকা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ও সিভিল কর্মচারীরা। যদিও ১৪ মাস পরে চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধে নিস্পত্তি হওয়ার পর ড্যানিশ শ্রীরামপুর আবার ড্যানিশদেরই ছেড়ে দেন ব্রিটিশরা। আবার নিজেদের শহর নিজেদের হেফাজতে আসে ড্যানিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির। এরপরই গভর্নরের থাকবার জন্য তৈরি হয় বিশাল একটি বাড়ি, যা বড় সাহেবের কুঠি নামে পরিচিত হয়। আজও কোর্ট চত্তরে বাড়িটি বড় সাহেবের স্মৃতির সাক্ষী দিতে দাঁড়িয়ে আছে। তখন গভর্নর কর্নেল ও বাই সাহেব। শোনা যায় কলকাতা থেকে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল ব্যারাকপুরে এলে, বাই সাহেব গঙ্গার এপার থেকে কামানের তোপধ্বনি করে তাঁকে সম্মান দেখান। এমনকি ব্রিটিশদের আমন্ত্রণে তিনি কয়েকবার কলকাতাতেও পৌঁছে গেছিলেন। এমনই ছিল ড্যানিশদের ঔপনিবেশিক উদাসীনতা। ব্রিটিশদের মতো বাঙালীর ভিটেমাটি কেড়ে নিতে ও চাবুক চালাতে তাঁরা এদেশে আসেন নি। প্রথম থেকেই তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বানিজ্য। শ্রীরামপুরের বাইরে মানদণ্ডকে রাজদণ্ড বানিয়ে ফেলার মতো দুঃসাহস তাদের একদিনের জন্যও মাথাচাড়া দেয় নি।
0 Comments.