Wed 22 October 2025
Cluster Coding Blog

প্রবন্ধে নবনীতা চট্টোপাধ্যায়

maro news
প্রবন্ধে নবনীতা চট্টোপাধ্যায়

লাফিং বুদ্ধ: জীবনের এক অন্য দর্শন

হাজার বছর আগের চীনের চর্চিয়া নামক স্থানের বৌদ্ধ মঠে সেদিন শোকের আবহাওয়া| মহাপ্রয়াণ করেছেন এক অত্যন্ত জনপ্রিয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী| শাস্ত্রানুযায়ী সন্ন্যাসীদের কবর দেওয়ার প্রথা , কিন্তু তাঁর শেষ ইচ্ছায় তিনি বলে দিয়েছিলেন যেন তাঁর শেষকৃত্য দাহ করা হয়| তাঁর অন্তিম ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে মঠের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তাঁর শবদেহটিকে দাহ করার ব্যবস্থা করেন| জনপ্রিয় এই বৌদ্ধসন্ন্যাসীর শেষকৃত্যে চারপাশের অনেক সাধারন মানুষ, তাঁর অনুসারীরা তাঁকে শেষ বিদায় জানাতে এসেছেন| সবাই শোকাহত, বিষন্ন| মঠের অন্যান্য সন্ন্যাসীরা চিতায় অগ্নিযোগ করালেন| তারপরেই এক আশ্চর্য ঘটনার সাক্ষী হলো সবাই| কথিত আছে তাঁর শবদেহটি থেকে মুর্হুমুর্হু আতশবাজির স্ফুলিঙ্গ বের হতে লাগলো| মৃত্যুর মত এক কষ্টদায়ক পরিবেশেও শোকার্ত সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো| চারিপাশের সাধারন জনতা তো হেসেই আকুল| সবাই বুঝতে পারলো মৃত্যুর আগেই তিনি তাঁর পোশাকের ভিতরে আতশবাজি ভর্তি করে রেখেছিলেন যাতে তাঁর অন্তিম দিনেও লোকে প্রাণভরে হেসে তাঁকে বিদায় জানাতে পারে| এই জনপ্রিয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর নাম কীয়েইচি| সারা বিশ্বে তিনি লাফিং বুদ্ধ নামে পরিচিত ও জনপ্রিয় আজো| আমরা অনেকেই তাঁকে গৌতম বুদ্ধের অন্য একটি রূপ বলে জানি| কিন্তু গৌতম বুদ্ধ আর লাফিং বুদ্ধ দুইজন সম্পূর্ণ আলাদা ব্যক্তিত্ব | গৌতম বুদ্ধ ছিলেন খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মানুষ আর লাফিং বুদ্ধ ছিলেন খ্রীস্টপূর্ব দশম শতকের| গৌতম বুদ্ধ ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের জাতক আর লাফিং বুদ্ধ চীনা বংশভূত এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী| ইতিহাস বলে লাফিং বুদ্ধ চীনের চর্চিয়ান প্রদেশের উত্তরে এক শহরের অধিবাসী ছিলেন| তাঁর আসল নাম ছিল বুদাই, হোতেই বা পুতেই| আবার তাঁর বৌদ্ধ নাম ছিল কীয়েইচি| তাঁর বিশাল মেদযুক্ত পেট, সম্পূর্ণ টাক ওয়ালা মাথা, মুখভরা হাসি আর কাঁধে বিশাল এক বস্তা বা ব্যাগ যা শিশুদের জন্য খাবার, উপহার, চকোলেটে ভরা, এই নিয়ে তিনি বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন| অন্য বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের থেকে তিনি ছিলেন একেবারেই আলাদা এক ব্যক্তিত্ব| শহর বা গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে তিনি কাঁধ থেকে ঝোলাটি মাটিতে নামিয়ে রাখতেন| শিশু, কিশোরেরা ছুটে আসত| তিনি তাঁর ঝোলা থেকে সব উপহার তাদের বিলিয়ে দিতেন| ব্যাগ খালি হয়ে গেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে হেসে যেতেন যেন খুব ই মজার কিছু ঘটেছে| তাঁর সেই হাসি সংক্রামিত হয়ে যেত শিশু ও কিশোরদের মধ্যে| তারা ও হাসতে শুরু করে দিত| সেই হাসির রোল ক্রমশ: ছুঁয়ে যেত পথচারী, স্থানীয় অধিবাসীদের মুখে| কোনো কারন ছাড়াই এক অনাবিল হাসির স্রোত লঘু করে দিত পরিবেশ, মানুষের মানসিক জগত| সর্বক্ষণ তিনি আপনমনে হেসে যেতেন| তাঁর এই হাসিমুখের জন্য তিনি যেখানে যেতেন সেখানে তাঁকে ঘিরে ভিড় জমে যেত এবং তাঁর হাসিমুখের জন্য সবাই তাঁকে লাফিং বুদ্ধ বলে অভিহিত করতো| তাঁর পরনে থাকতো চটের একধরনের ঢিলেঢালা বস্ত্র যা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা সবসময়ে পরে থাকতেন| ইতিহাসমতে বুদাই ছিলেন একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুক যিনি লিয়াং সাম্রাজ্যের পর (৯০৭-৯২৩) চীনদেশে বাস করতেন| তিনি ছিলেন একজন সৎ, স্নেহপ্রবণ, পরোপকারী হাস্যমুখর বৌদ্ধ সন্ন্যাসী| ভগবান বুদ্ধের উপদেশ ও নীতি অধ্যয়ন করতে করতে তাঁর আত্মজ্ঞান হয়| এরপর থেকে তিনি হাসানোর মাধ্যমে লোককে আনন্দ দেবার চেষ্টা করতেন| সেই হাসির ভিতর কোনো উপহাস, বিদ্রুপ, ব্যঙ্গ থাকতো না| শুধু অনাবিল এক আনন্দ ঝর্ণাধারার মতো হৃদয়ের উৎসমুখ থেকে ছড়িয়ে পড়তো| জাপানী লোককথা অনুযায়ী হোতেই ছিলেন হাসি ও আনন্দের প্রতিমূর্তি এক বৌদ্ধ ভিক্ষু| অনেক বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ঐতিহ্য অনুযায়ী বুদাই ছিলেন মৈত্রেয় বা ভবিষৎ বুদ্ধ| প্রকৃতপক্ষে তাঁর চালচলন, আচার ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি এক অন্য জীবন দর্শনের ঈঙ্গিত দিয়ে গেছেন| তাঁর স্টাচুগুলিতে তাঁকে খুব সাধারণ চটের ঢিলা পোশাক পরতে দেখা যায়| এই ভাবমূর্তির অর্থ হল তিনি দরিদ্র অথচ আত্মসন্তুষ্টিতে পরিপূর্ণ| তাঁর কাঁধে থাকা ঝোলাটি মানুষের জাগতিক দু:খ, কষ্ট, সমস্যার প্রতীক| তিনি কাঁধ থেকে তাঁর থলেটি নামিয়ে হেসে উঠতেন| তিনি বোঝাতে চাইতেন সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমে সমস্যা থেকে নিজেকে বিচ্যুত করতে হবে| আমরা যখন সমস্যায় পড়ি তখন তা থেকে বের হওয়ার রাস্তাখুঁজে পাওয়া আমাদের কাছে কঠিন হয়ে পড়ে| তাই সমস্যা থেকে প্রথমে নিজেকে বিচ্যুত করতে হবে, তবেই সমস্যার সমাধানের পথ পাওয়া যাবে এবং মনে শান্তি মিলবে| জীবন এক নির্দিষ্ট সময়কালীন ভ্রমণ| নিজেকে, চারিপাশস্থ সবাইকে হাসি আনন্দ দিয়ে পার হতে হবে এই পর্যটন| প্রতিদিন শিশুদের যে চকোলেট, খাবার দিয়ে তিনি ঝোলা খালি করে কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখতেন, তাঁর সহজ সরল জবাব ছিল মানুষ যত দেবে তত পাবে| জগতের নিয়ম এটাই| তাই যার যতটা সামর্থ্য দেওয়া উচিত, তার দ্বিগুণ সে ফেরত পাবে| আজো সারা বিশ্ব জুড়ে লাফিং বুদ্ধের মূর্তিগুলির বিভিন্ন ভঙ্গিমা মানব জীবনের বিভিন্ন দর্শনের মাত্রা বহন করে| তাঁর বসার ভঙ্গি শান্তি ও সুষম চিন্তার প্রতীক, তাঁর ডান কাঁধে ঝোলা এবং বাম দিকে একটি পাখা বহন করে দীর্ঘ যাত্রার সময়ে সুরক্ষা, বুদ্ধের পিঠের স্বর্ণের ব্যাগ সমৃদ্ধির প্রতীক, বুদ্ধের এক বোতলে করলা, অন্য হাতে পাখা সুস্বাস্থ্যের প্রতীক. মাথায় টুপি দিয়ে তাঁর মূর্তি সৌভাগ্যের প্রতীক| প্রতিটি মূর্তিতে তাঁর হাস্যমুখ এক পজিটিভ এনার্জির বাহক| চীনা বাস্তুতন্ত্র অনুযায়ী লাফিং বুদ্ধকে বিশ্বের অন্যতম বিশিষ্ট ফেং শুই ব্যক্তিত্ব হিসাবে মান্য করা হয়| শুধু চীন নয়, সারা বিশ্ব জুড়ে লাফিং বুদ্ধের এই মান্যতা রয়েছে| ফেং শুই নীতি অনুসারে লাফিং বুদ্ধের মূর্তি বিভিন্ন জায়গায় স্থাপন করা উচিত কারন লাফিং বুদ্ধ নেতিবাচক শক্তিকে প্রতিহত করে মানব জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্য এনে দেয়| তাই বাড়ির প্রধান প্রবেশ মুখে মূর্তি স্থাপন করলে কোনো নেতিবাচক শক্তি গৃহে প্রবেশ করবে না| ফেং শুই মতে লাফিং বুদ্ধ গৃহের পক্ষে অত্যন্ত শুভ| এর শুভ প্রভাবে সংকট কেটে গিয়ে জীবনে আনন্দ আসে, সৌভাগ্য বৃদ্ধি হয়| হতাশা কেটে গিয়ে পরিবেশ হাসিখুশিতে ভরে যায়| এই হাস্যরত বুদ্ধকে পুজা করার প্রয়োজন হয় না, আরাধনা ও করতে হয় না| কেবল মাত্র পরিস্কার স্থানে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে হয়| বর্তমানে লাফিং বুদ্ধের মঙ্গল ময় উপস্থিতির জন্য প্রায় প্রতিটি গৃহে. অফিসে. রেস্তোরায়, পাঠকক্ষে, গাড়ীর ভিতরেও লাফিং বুদ্ধ মূর্তি সাজিয়ে রাখতে দেখা যায়| একটি জনপ্রিয় চীনা লোকবিশ্বাসের মতে লাফিং বুদ্ধের পেতে হাত ঘষলে সমৃদ্ধি, সৌভাগ্য ও প্রাচুর্যতা জীবনে আসে| জাপানী লোকগাথায় হোতেইকে সাত সৌভাগ্যবান দেবতার একজন বলে ধরা হয়| হাসি এমন এক রসায়ন যা দিয়ে দূর করা যায় জীবনের যাবতীয় অবসাদ, মলিনতা,, ক্লান্তি, বিষাদ| নেতিবাচক শক্তিকে নিস্কাশন করে খেলে যায় ইতিবাচক হাওয়া| এই জগতের স্রষ্টা একমাত্র মানুষকেই দিয়েছেন এই দুর্লভ শক্তি| আজ থেকে হাজার বছর আগে এক চীনা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী জীবনকে হাসি দিয়ে ভরিয়ে রাখার দর্শন শিখিয়েছিলেন| আজকের ইন্টারনেট, স্পেস অভিযানে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া মানব সমাজ, হাতের মুঠোয় বিশ্বকে নিয়ে ফেলার মানব সমাজ আজো হাজার বছর আগের সেই দর্শনকে অনুসরন করে তৈরী করেছে লাফিং ক্লাব| আধুনিক মানুষ প্রাণভরে হাসার আনন্দের গুরুত্ব আজ বুঝতে সক্ষম হয়েছে| হাজার বছর আগের সেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর জীবন দর্শন আজ আমাদের কাছে এক আলোকবর্তিকা|

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register