Mon 27 October 2025
Cluster Coding Blog

ধারাবাহিক প্রবন্ধে তপশ্রী পাল (পর্ব - ৩৬)

maro news
ধারাবাহিক প্রবন্ধে তপশ্রী পাল (পর্ব - ৩৬)

আলাপ

আগের পর্বের শিব-হরির কথা যেখানে ছেড়ে এসেছিলাম, শুরু করছি আবার সেখান থেকেই। এবার প্রথমে এই জোড়ির অপর শিল্পী পন্ডিত শিবকুমার শর্মার কথা। তারপর আবার ফিরে যাব তাঁদের জোড়ির কথায়। ১৯৫৫ সাল। পুণেতে মার্গ সঙ্গীতের বিখ্যাত হরিদাস সম্মেলন আয়োজিত হয়েছে। সেখানে কে নেই? রয়েছেন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান, আমীর খান, মুস্তাক হুসেন খান, রসুলন বাঈ, কেসরবাঈ, পন্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, নারায়ণ রাও ব্যাস, বিনায়ক রাও পটবর্ধন, সিদ্ধেশ্বরী দেবী, মোঘুবাঈ কুরদিকর প্রভৃতি অসংখ্য অসাধারণ শিল্পী! তাঁরা একের পর এক স্টেজে উঠছেন আর মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছেন শ্রোতারা। অনুষ্ঠানের আয়োজকরা সেবার এক নতুন শিল্পীর সন্ধান পেয়েছেন যার বয়স মাত্র সতেরো! সে বাজায় একেবারে নতুন একটি যন্ত্র, যা আগে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসরে কেউ বাজায়নি! যন্ত্রটি একটি পাহাড়ী লোকযন্ত্র, যেটি উত্তরাখন্ড, কুমায়ুন ও জম্মু কাশ্মীরের পাহাড়ে বাজিয়ে ঘোরে লোকসঙ্গীত শিল্পিরা! যন্ত্রটিতে পাহাড়ী মিঠে ঠান্ডা হাওয়ার টুংটাং মূহূর্তে মনকে আনন্দে ভরে তোলে! কিন্তু এমন একটি যন্ত্র মুম্বই রেডিওতে বাজায় ছেলেটি এবং তাও বিশুদ্ধ রাগরাগিনী! সেই বাজনা সমঝদার গুণীদের শোনাবার খুব ইচ্ছে আয়োজকদের! ছেলেটি তো বাজাতে রাজী হলো, কিন্তু তার একটিই শর্ত, সে প্রথমে স্টেজে তবলা লহরা বাজাবে, তারপর বাজাবে সন্তুর, অর্থাৎ সেই যন্ত্রটি! যদিও সেদিন প্যানেলে বাজানোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন উস্তাদ আল্লারাখা খান, পন্ডিত আনোখেলাল, শামতা প্রসাদ, কিষণ মহারাজ, উস্তাদ আহমদজান থিরাকুয়া প্রভৃতি, কিন্তু আয়োজকদের ছেলেটির শর্ত মেনে নিতে হলো। ছেলেটি প্রথমে আধ ঘন্টা তবলা বাজালেন, তারপর তবলা পাশে সরিয়ে রেখে কোলে তুলে নিলেন সন্তুর! সমবেত বিখ্যাত উস্তাদ ও পন্ডিতেরা মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনলেন অপূর্ব তবলা এবং ততোধিক অপূর্ব সন্তুর বাদন! দেড় ঘন্টার অনুষ্ঠানের পরও সবাই “ঔর এক, ঔর এক” ধ্বনি তুললেন! এইভাবে একটি লোকযন্ত্রকে একার চেষ্টায় শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের দুনিয়ায় নিয়ে এসেছিলেন পন্ডিত শিবকুমার শর্মা।

১৯৩৮ সালে জম্মুতে পন্ডিত শিবকুমার শর্মার জন্ম হয়। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বেনারস ঘরানার শিল্পী পিতা উমাদত্ত শর্মার কাছে তাঁর শিক্ষা শুরু হয়। প্রথমে গায়ন এবং পরে তবলাবাদনে তাঁর শিক্ষা। অবশেষে এগারো-বারো বছর বয়সে পিতার আদেশে হাতে তুলে নেন সন্তুর। সন্তুর এমন একটি যন্ত্র, যাতে একশত তার আছে। একটি বাক্সের মতো কাঠের ফাঁপা যন্ত্রের অপর এই সরু সরু তারগুলি দুপাশে ছোট ছোট চাবিতে আটকানো। দুটি লম্বা ধাতব কাঠি দিয়ে আঘাত করে বাজানো হয়। খানিকটা ক্সাইলোফোনের মতো টুংটাং শব্দ সন্তুরের। জম্মুতে পাহাড়ী যন্ত্র হিসাবে যদিও জনপ্রিয়, কিন্তু এতে শাস্ত্রীয় রাগরাগিনী ও মীড় বাজানো খুবই শক্ত! এ ব্যাপারে অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষা চালাতে লাগলেন উমাদত্ত শর্মা! কিছু পরিবর্তন আনলেন সন্তুরের আকৃতি, তার ও বাজানোর পদ্ধতিতে। ক্রমে যন্ত্রটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বাজানোর উপযুক্ত হয়ে উঠলো! নিজের সাধনা ও পিতার শিক্ষায় কিছুদিনের মধ্যেই এক স্বয়ং সম্পূর্ণ শিল্পী হয়ে উঠলেন শিবকুমার! ১৯৫৫ সালে সেই হরিদাস সম্মেলনেই আরেকটি ঘটনা ঘটে। অনুষ্ঠানটি শুনতে এসেছিলেন ভি শান্তারামের মেয়ে মধুরাজী! তিনি শিবকুমারের বাজনা শুনে মুগ্ধ হন এবং বাবাকে এসে বলেন যে তাঁদের ফিল্ম ঝনক ঝনক পায়েল বাজে তে সন্তুরবাদন নিয়ে আসতেই হবে! অবশেষে তার জেদাজেদিতে রাজী হন শান্তারামজী! কিন্তু শিবকুমার শর্মা প্রথমে বাজাতে রাজী হননি। পরীক্ষার দোহাই দিয়ে তিনি দেশে ফিরে যান। কিন্তু পরীক্ষার পর রাজকমল স্টুডিও থেকে তার কাছে টেলিগ্রাম আসে তখনি মুম্বই যাওয়ার জন্য। এবার আর না করতে পারলেন না শিবকুমার। এই ছবির নায়ক ছিলেন বিখ্যাত কত্থক নাচিয়ে গোপীকিষণজী। ছবিটির টাইটেল সং গেয়েছিলেন স্বয়ং উস্তাদ আমীর খান সাহেব। এইসব বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গেই ছবিতে সন্তুর বাজালেন শিবকুমার শর্মা। প্রবল হিট হয় এই ছবি। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি পন্ডিত শিবকুমার শর্মাকে। একদিকে তিনি দেশে বিদেশে প্রায় সব শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্মেলনে বাজাতে লাগলেন, অন্যদিকে পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার সঙ্গে তৈরী হলো তার অনন্য জুড়ি শিব-হরি। তবে জুড়ি তৈরী করার আগেও আলাদা আলাদা ভাবে বহু সিনেমায় বাজিয়েছেন দুজনেই। প্রথমে বলি শিবকুমারজীর কথা। তাঁর সিনেমায় বাজানো শুরু হয় শচীন দেব বর্মনজীর হাত ধরে। তাঁকে শচীনদেব বর্মনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন আরেক সুরকার জয়দেব। সেটি ১৯৬০ সালের কথা। তখন শচীনদেব হাম দোনো ছবির কাজ করছেন। ফোরটিন্থ রোডে থাকতেন শিবকুমারজী। জয়দেবজী তাঁকে বর্মন দাদার কাছে নিয়ে আসেন। শচীনদেব বর্মন নিজে একাধারে লোকসঙ্গীত ও শাস্ত্রীয়সঙ্গীতে বিশেষ পন্ডিত ছিলেন এবং তার সুর দেওয়ার স্টাইল ছিলো একেবারেই তার নিজস্ব। সেই সময় সব সুরকারের নিজস্বতা ছিলো। শুনলেই বলে দেওয়া যেতো কার সুর। কিন্তু শচীনদেব তার স্টাইল সত্ত্বেও সিনেমার সিচুয়েশন ও কে অভিনয় করছেন তার ওপর নির্ভর করে স্টাইল পাল্টাতেন। তিনি গানে খুব হালকা অর্কেস্ট্রেশন পছন্দ করতেন। বলতেন সুন্দরী নারীকে বেশী সাজালে ভালো লাগে না। শিবপ্রসাদের সন্তুর তার খুব পছন্দ হলো। তিনি তাঁকে বারবার ব্যবহার করতে লাগলেন তার বিভিন্ন সিনেমায়। শিবকুমারজী স্মরণ করেছেন শচীনদেবের কিছু মজার অভ্যাস। তিনি পান খেতে খুব ভালোবাসতেন। চারদিকে ঘিরে লোক বসে থাকলেও তিনি নিজের পানটি মুখে দিতেন, কাউকে সাধতেন না খাওয়ার জন্য। কিন্তু কারো গান বা বাজনা পছন্দ হলে তখন বলতেন “তুম খাওগে?” সে যদি নিতে দ্বিধা করতো তক্ষুণি সেই পানটিও মুখে পুরে বলতেন “ও! তুমি খাও না!” শিবকুমারজীকে প্রথম কখদিনই পান খেতে বলেছিলেন। সেই সময় হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়াজীও বর্মন দাদার কাছে আসতেন বিভিন্ন সিনেমায় বাজানোর জন্য। একদিন দুজনেই বসে আছেন বর্মন দাদার সামনে, এমন সময় ভিতর থেকে মীরা দেববর্মন এক প্লেট রসোগোল্লা পাঠিয়ে দিলেন শচীনদেবের জন্য, যা সেদিনই কলকাতা থেকে এসেছিলো। বর্মন দাদা একমনে সুর করে যাচ্ছেন, শিবজী হরিজীর মন কিন্তু রসগোল্লার প্লেটে। টুকটাক রসগোল্লা খালি হতে লাগলো। শচীনদেব কিছু বলছেন না। সুর দেওয়ার শেষে প্লেট খালি। পরদিন যখন দুজনে স্টুডিওতে রেকর্ড করে বেরোচ্ছেন শচীনদেব বললেন “বহোত মিঠা বাজায়া! কাল দশ বারা রসগুল্লা যো খা লিয়ে থে!” এই ভাবেই তৈরী হয়েছিলো এবং বাজিয়েছিলেন এঁরা দুজন শচীনদেব বর্মনের বিভিন্ন হিট ছবিতে, যেমন - -      দিল কা ভমর করে পুকার - তেরে ঘর কে সামনে, -      আঁখ খুলতে হি - মুনীমজী -      রুলাকে গয়া সপনা – জুয়েল থিফ -      পিয়া বিনা পিয়া বিনা – অভিমান -      জানে ক্যা তুনে কহি – পিয়াসা -      মোসে ছল কিয়ে যায় – গাইড অমর সব গান তৈরী হয়েছিলো এই গুনী সঙ্গীতকার ও শিল্পীদের সমন্বয়ে। শচীনদেব বর্মন ছাড়াও তাঁরা বাজিয়েছেন বি আর চোপড়ার অনেক সিনেমায়। এরপর আসে আশি ও নব্বইয়ের দশক। ততদিনে শিবকুমারজী এবং হরিপ্রসাদজী দুজনেই পুরোপুরি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দুজনের দেখা হলেই তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করতেন সেই স্বর্নালী দিনগুলির কথা। ততদিনে শচীনদেব মারা গেছেন, রাহুলদেব বর্মনও আর আগের মতো সুর দিতে পারছেন না। একমাত্র বাপ্পি লাহিড়ী ছাড়া তখন কোন ভালো সুরকার নেই। হয় তাঁরা মারা গেছেন বা সুর করা ছেড়ে দিয়েছেন। হিন্দী গানের জগতে মেলোডি বিদায় নিয়েছে ডিস্কো গানের কাছে। এমন একটা সময়ে যশ চোপড়া ডেকে নিলেন এই দুজন বিখ্যাত শিল্পীকে তার যশরাজ ফিল্মের ব্যানারে জুড়ি হিসাবে সুর করার জন্য। কিন্তু শিবজী ও হরিজীর হাতে তখন একেবারেই সময় নেই। তাঁরা দেশ বিদেশের কন্সার্ট হল এবং স্টুডিওতে ব্যস্ত। অনেক অনুরোধের পর ১৯৮০ তে সিলসিলা সিনেমার জন্য তাঁরা দুজন একসঙ্গে সুর দিতে সম্মত হলেন। কিন্তু ফিল্ম জগতের অনেকে বললেন দুজন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী ফিল্ম সঙ্গীত কী বুঝবেন? কেমন করে সুর দেবেন সিনেমার গানে? আবার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতের মানুষেরা বললেন এমন দুজন শিল্পী নিজেদের বাজনার বিশুদ্ধতা নষ্ট করছেন ফিল্মে সঙ্গীত দিয়ে। কিন্তু এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না শিব-হরি, কারণ তাঁরা দুজনেই বহু সিনেমায় বাজিয়েছেন তার আগে, কাজ করেছেন বরেণ্য সুরকারদের সঙ্গে, যা এই সমালোচকরা জানতেন না। তৈরী হলো শিব-হরি জুটির কিছু অদ্ভুত সুন্দর মেলোডি ও সঙ্গীত! ১৯৮১ সালে রিলিজ হলো সিলসিলা। তৈরী হলো “দেখা এক খাব”, “নীলা আসমান সো গয়া”, “ইয়ে কাহাঁ আ গয়ে হম” এর মতো গান! শেষ গানটিতে প্রথমবার একটি গানের একটি অংশ লতা মঙ্গেশকর গান হিসাবে গেয়েছেন, আর একটি অংশ আবৃত্তি করেছেন অমিতাভ বচ্চন। এ ছাড়াও এই ছবিতে ছিলো “রং বরসে” র মতো এক চিরকালীন হিট গান! এরপর ফাসলে, বিজয়, চাঁদনী, লমহে, পরম্পরা এবং ডর ছবিতে একের পর এক অসাধারণ সব গান তৈরী করলেন দুজন! তাঁদের জুটির নটি সিনেমার গানের মধ্যে আটটি সিনেমাই যশ চোপড়ার ব্যানারে। এর পাশাপাশি ২০০১ সালে পদ্মবিভূষণ পেলেন পন্ডিত শিবকুমার শর্মা! আজও অশীতিপর বয়সে ছেলে রাহুল শর্মার সঙ্গে দেশে বিদেশে বাজাচ্ছেন পন্ডিতজী, বাজাচ্ছেন যুগলবন্দী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক লেবেলের হয়ে, তৈরী করছেন ফিউশন সঙ্গীত! কিন্তু তা তার শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের রসকে বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ না করে। তাঁদের প্রতিভার এই ব্যাপ্তির জন্যই তো তাঁরা মায়েস্ত্রো! পন্ডিত শিবকুমার শর্মা বিভিন্ন সাক্ষাতকারে বারবার বলেছেন যে তিনি সারা জীবন অনুভব করেছেন যে কোন এক ঐশ্বরিক শক্তি (ডিভাইন ফোর্স) তাঁকে সঙ্গীতের এই জার্নিতে সাহায্য করেছে, এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমি বহুবার শিবকুমার শর্মার বাজনা শুনেছি। প্রত্যেকবার কোথায় যেন হারিয়ে গেছি পন্ডিতজীর “পাহাড়ী” ধুন শুনে! বড়ো মিঠে সেই সুর!

শিব-হরির কথা দিয়ে শেষ করলাম হিন্দুস্থানী যন্ত্রঘরানা ও সঙ্গীতকারদের কথা। এরপর ছোট করে বলবো বিভিন্ন তবলা ঘরানাগুলির ও দু একজন অসাধারণ তবলা-গুণীর কথা।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register