Mon 27 October 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে অয়ন ঘোষ (পর্ব - ৫)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে অয়ন ঘোষ (পর্ব - ৫)

বেদ-কথা 

আবহমান কাল ধরে এই দেশের মেধা ও মনন মানবিক ও মানসিক জীবন চর্চার দিশারী। ইতিহাস যবে থেকে লেখা হলো বা এর চর্চা শুরু হলো, তবে থেকেই দেখা যাচ্ছে বহমান জীবনের অজস্র স্রোতধারা এর মূল স্রোতের সাথে এসে মিশেছে, কখনো শত্রুর বেশে বা কখনো আশ্রিতের অধিকারে আর সব কিছুকে ধারণ করে প্রতিদিন প্রাণের সম্মানে ধন্য হয়ে উঠেছে এই বিস্তীর্ণ ভূমি। এতো বিরুদ্ধ প্রবাহ ধারণ করলেও, এর অন্তর আত্মাটি স্থির অবিচল ও লক্ষ্য অভিমুখী ছিল তখনও, আছে আজও। মাঝে মাঝে প্রশ্ন তৈরি হয়, এতো মনের জোর এই মাটি পেলো কোথা থেকে? এর মননের ভিত্তি এতো দৃঢ় কোন সোনার কাঠির ছোয়ায়? তখনই অতি দূর হতে ভেসে আসে বাঁশির মদির মন্দ্র বা প্রাণের মন্ত্র কানে কানে বলে " তস্য ভাসা সর্বম্ ইদং বিভাতি" ( কঠোপনিষৎ, ২.২.১৫) অর্থাৎ তাঁরই আলোয় সব কিছু প্রকাশমান। এই তিনি বা "তাঁর" এর খোঁজ আমাকে পৌঁছে দিল সত্য জ্ঞানের দুই কল্প বৃক্ষের নীচে তার সুশীতল ছায়ায় মন পেতে শুনলাম কে যেনো নিরবধি বলে চলেছে জগতের এই আনন্দ আয়োজনে আমাদের সবার নিমন্ত্রণ - সেই অজর অমর অক্ষয় কল্প বৃক্ষ দুটির নাম বেদ আর সেই বেদের ছায়ায় জন্ম নেওয়া উপনিষদ। আমাদের আদি পুরুষরা ঈশ্বরের নিকট এই প্রার্থনা পৌঁছে দেবার একটি সহজ, সুন্দর ও স্বতন্ত্র পথ নির্বাচন করেছিলেন। যে সুন্দর পরমা প্রকৃতির মধ্যে ও সান্নিধ্যে তাঁরা বাস করতেন ও তার থেকেই সংগ্রহ করতেন জীবন রসদ তারই ওপর দেবত্ব আরোপ করে স্তোত্র ও মন্ত্রের নিবেদন করলেন তাঁদেরই উদ্দেশ্য। যেহেতু এদের অনুগ্রহে জীবন পরিপূর্ণ তাই তাদের দেবতা হিসেবে দেখে রচনা করা হয়েছে প্রশস্তি ও প্রার্থনা। এই পথ ধরে পঞ্চ ভূত ( Five Elements), যা দিয়ে তৈরি এই মূর্ত শরীর ও যা আমাদের সামনে চির প্রকাশমান, তাদের ওপর দেবত্ব আরোপ করা হলো - অগ্নি, জল, বায়ু, আকাশ ও আকাশে স্থিত সূর্য। প্রাচীন সেই স্তোত্র বা সূক্ত নিয়েই গড়ে উঠেছে বেদ। প্রাচীন সেই স্তোত্র বা সূক্ত নিয়েই গড়ে উঠেছে বেদ। বেদের এই মূল অংশটিকে বলা হয় "সংহিতা" আর যে প্রাচীন ভাষায় এর রচনা তাকে বলা হয় বৈদিক ভাষা। কিন্তু শুধু মন্ত্র বা স্তোত্র পাঠ করলেই তো হবে না তার সঙ্গে চাই অনুসারী ক্রিয়া বা আচার অনুষ্ঠান। সেই অনুসারী ক্রিয়াকে বলা হতো যজ্ঞানুষ্ঠান। যজ্ঞের জন্য একটি বেদী নির্মিত করা হলো এবং তাতে অগ্নি সংযোগ করে বেদের মন্ত্রগুলি সুরের সাথে উচ্চারিত হতো। এরই সাথে ছিল আহুতি দেওয়ার প্রথা। আহুতি মূলত দুধরনের - ঘি অথবা সোমরসের। ঘি এর আহুতি দেওয়া হলে, সেই যজ্ঞকে বলা হতো 'হর্বি যজ্ঞ' আর সোমরস আহুতি দেওয়া হলে 'সোম যজ্ঞ'। যজ্ঞ মানেই অগ্নির উপাসনা ও প্রধান ভূমিকাও অগ্নির তাই অগ্নিকে " যজ্ঞস্য দেবম্ " নামে ডাকা হতো। কিন্তু যাগযজ্ঞ তো আর একা মানুষ করতে পারে না। এতে অনেক লোকের প্রয়োজন হয়ে পড়ত এবং তাদের প্রত্যেকের ভূমিকাও নির্দিষ্ট ছিল; যিনি সূক্ত পাঠ করেন তিনি হোতা, যিনি গান করেন তিনি উদ্গাতা, যিনি আহুতি অর্পণ করেন তিনি অধ্বর্যু। সেই যুগের মানুষের জীবন অনেক নিয়মনিষ্ঠ থাকত তাই যজ্ঞের এই বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান এর নির্দিষ্ট লিখিত রূপরেখা প্রয়োজন হলো যাতে সব কিছু বিধিবদ্ধ থাকে। যজ্ঞের এই বিধান বা বিধিবদ্ধ লিখিত রূপ "ব্রাহ্মণ"। সেই সব যজ্ঞের নানাবিধ নামকরণ করা ছিল - অগ্নিষ্টোম, জ্যোতিষ্টোম, বিশ্বজিৎ, এছাড়া দিন ভিত্তিক যজ্ঞও করা হতো আর সেই অনুযায়ী হতো নামকরণ। যেমন যজ্ঞের স্থায়িত্ব ১২ দিনের অধিক হলে তাকে 'সত্র' নামে ডাকা হতো। বেদের ব্রাহ্মণ অংশে মূলত যজ্ঞের কার্যপ্রণালী বর্ণনা করা হয়েছে সেই জন্য ব্রাহ্মণ অংশকে কর্মকাণ্ড বলা যেতে পারে। আরণ্যকে বিশেষ করে উপনিষদ অংশে জ্ঞানযোগের আলোচনা মুখ্য বিষয় তাই উপনিষদকে জ্ঞানকাণ্ড বলা যেতে পারে। কর্মকাণ্ডপ্রধান ব্রাহ্মণ অংশ ও জ্ঞানকাণ্ডপ্রধান উপনিষদ অংশ হতে দুটি প্রধান ভারতীয় দর্শন শাখার উদ্ভব হয়েছে। বেদের ব্রাহ্মণ ভাগকে অবলম্বন করে পূর্ব মীমাংসা দর্শন তৈরি হয়েছে এর রচয়িতা ঋষি জৈমিনি। এই দর্শনকে কর্মমীমাংসা বা ধর্মমীমাংসা বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন ব্রাহ্মণ গ্রন্থের মধ্যে যে আপাত বিরোধ লক্ষ্য করা যায় তার একটি সুচারু সমন্বয় এই দর্শনে করা হয়েছে এবং সেটা বেদের প্রামাণ্যতাকে মাথায় রেখে। উপনিষদকে অবলম্বন করে রচনা করা হয়েছে উত্তর মীমাংসা-দর্শন এর রচয়িতা বাদরায়ন ঋষি।অনেক পন্ডিত মনে করেন বেদব্যাসের আরো একটি নাম হল বাদরায়ন। এই দর্শনের ওপর একটি নাম ব্রহ্মমীমাংসা বা বেদান্ত দর্শন তাই এই দর্শনের সূত্রগুলিকে একত্রে ব্রহ্মসূত্র বলা হয়। উপনিষদের প্রবচন গুলির মধ্যে যেসকল আপাত বিরোধ রয়েছে তার সমাধান ও সমন্বয় এই দর্শনের মুখ্য বিষয়। সনাতন হিন্দু ধর্মের বিশ্বখ্যাত সারসংক্ষেপ হল শ্রীমদ্ ভগবত গীতা। গীতাকে উপনিষদের সারাৎসার বলা যেতে পারে। এভাবে ভাবা যেতে পারে উপনিষদগুলি হচ্ছে কামধেনু স্বরূপ। যশোদা নন্দন মুরলীধর শ্রীকৃষ্ণ তার মানব রূপে সেই গাভীগুলিকে দোহন করছেন। সেই দোহনের সেই অমৃতস্বরূপ দুগ্ধ হচ্ছে গীতা এবং গোবৎসের ন্যায় তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন সেই গীতা স্বরূপ দুগ্ধ পান করছেন। বাছুরের সাহায্য ছাড়া যেমন দুগ্ধ দোহন করা যায় না ঠিক তেমনই গীতার সারস্বত বাণী অর্জুনের মাধ্যমে গোটা জগতকে মথিত করছে: "সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধ গীতামৃতং মহৎ" চলবে...
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register