Sat 25 October 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব - ১৪)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব - ১৪)

পদাতিক

ডাইনিং রুমের একদম শেষের দিকের টেবিলটায় এসে বসলাম দুজনে। আমি আর বুদ্ধদেব মাষ্টার মুখোমুখি। আমি দরজার দিকে পেছন ফিরে আর মাষ্টার জানালার দিকে। এ টেবিলটা আমার খুব প্রিয়। মুখোমুখি জানালা দিয়ে বেশ সুন্দর গ্রামের ছবি দেখতে পাই। গাছ গাছড়ার ফাঁকে ফাঁকে খড়ের ছাউনি দেওয়া বাড়িগুলো যেন লজ্জাশীল নববধূর মতো ঘোমটার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকে। ক্ষেতের কোথাও বীজতলা রোওয়া হয়েছে তো কোথাও হাল দেওয়া চলছে। হলের জানালার ঠিক বাইরেই বেশ কটা তিনচারতলার সমান উঁচু ইউক্যালিপটাস গাছের নীচের দিকের ডালে ঝিরিঝিরি পাতারা সারাদিন ধরে দোল খেয়েই চলে। এখন অবশ্য রাত। বাইরের ঘরগুলো থেকে টিমটিমে আলোর আভাসে বেশ একটা আলো আঁধারি তৈরি করেছে। আমার বাঁদিকে রসুইঘর। ইয়া পেল্লায় পেল্লায় কড়াই, আর বড়ো বড়ো বার্নারগুলো এখন আশ্চর্যরকম চুপ। রান্নাঘর ধোওয়া মোছার কাজ শেষ করে শর্বাণীদি, সীমা, মিনুরা খেতে বসার তোড়জোড় করছে। আমাদের দুজনকে ভাত ডাল আর সবজি বেড়ে দিয়ে দুইবোনও এসে পাশের টেবিলে থালা নিয়ে বসলো। -- কিরে? তোরাও খাসনি এখনও? নিশ্চয়ই জ্যেঠুর সাথে বসে গল্প করছিলি? সীমা মাছের গামলাটা এনে টেবিলে রাখলো। -- তুমি এতো রাত করে খাও কেন গো জ্যেঠু? তোমার তো বয়েস হয়েছে, তাই না? কি খাবে বলো, কোল দেবো না গাদার মাছ খাবে? এদেরকে দেখি আর অবাক হয়ে যাই, উদয়াস্ত কী পরিশ্রমটাই না করে এরা। সেই সকাল ছটায় এসে বাচ্চাদের জন্য টিফিন রান্নার কাজ শুরু করে আর এদিকে একদম রাত বারোটা পর্যন্ত সমানে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যায়। অথচ কখনোই কারো কালো মুখ দেখিনি এখনো। সবসময় হাসিমুখে পরিশ্রম করে যাচ্ছে। --- আজ কোলের মাছ দেবোনা তোমাকে। একটু তেতো লাগতে পারে। তুমি আজ গাদারটাই খাও। -- তাহলে কোলের পিসগুলোর কি হবে? ওগুলো কে খাবে? -- তোমার অতো ভাবতে হবে না তো! -- নিশ্চয়ই তোরাই খাবি। তাই না? ওই শোন... ---- উফ, এই মানুষটাকে নিয়ে আর পারি না। সীমা মাছের গামলাটা নিয়ে ওরা যে টেবিলে বসার আয়োজন করেছে সে টেবিলে রাখলো। --- এরা এরকমই জ্যেঠু। সবাইকে খাইয়ে যাকিছু উদ্বৃত্ত, সেগুলোই সবাই মিলে আনন্দ করে খাবে এরা। আপনি খান, এদেরকে বললে এরা বিব্রত হবে। খেয়ে উঠে আমি আর মাষ্টার রোজদিনই রান্নাঘরের সামনের যে ফাঁকা জায়গাটা আছে সেখানকার দোলনায় গিয়ে দোল খাই কিছুক্ষণ। আজ সত্যি সত্যিই রাত অনেকটাই হয়েছে। আশ্রমের রাস্তাঘাটগুলোর আলো সব নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। ছেলেমেয়েদের থাকার বাড়িগুলোতেও বেশীরভাগ ঘরের আলোও নিভে গেছে। বাঁ পাশের ঠাকুরঘরের আলোটা জ্বলে আছে। ডাইনিংরুমের টেবিলগুলোকে ধোওয়া মোছা শেষ করে মিনুরাও খাওয়ার ঘরের আলো নিবিয়ে দিয়ে দরজাতে তালা ঝোলালো। --- কি গো জ্যেঠু, তোমরা শোবেনা আজ? মণিকরণ এসে সামনে দাঁড়ালো। এই মেয়েটাকে যতোই দেখি অবাক হয়ে যাই। কিচেন ডাইনিং এর দায়িত্বে থাকা মেয়েটি বলরামবাবুর ছোট মেয়ে। কিন্তু দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। রান্নাঘরের মেয়েদের সাথে সমানে কোমড় বেঁধে কাজ করে যায়। রান্নাবাড়া থেকে শুরু করে খেতে দেওয়া, বাসনকোসন পরিষ্কার করা, সবকিছুই একসাথে করে যায়। মালিক কর্মচারীদের ভেতর কোনোরকম প্রভেদ নেই। --- মাষ্টারমশাই, তোমরা এবার শুতে যাও গো, জ্যেঠুর তো আবার সেই ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠতে হয়। বাচ্চাদের নিয়ে বসতে হয় সেই সাতসকালে। চার পাঁচ ঘন্টা না ঘুমোলে চলবে কীকরে? --- এরা এদের এই স্নেহের বাঁধনেই বেঁধেছে আমায়। সবাইমিলে চারদিক দিয়ে এভাবে ঘিরে রেখেছে যে এদের এই স্নেহের বাঁধন ছেঁড়ার সাধ্যি আমার নেই। --- চলো হে মাষ্টার। এই মেয়েটা আমাদের ঘরে না ঢুকিয়ে নিজে শুতে যাবেনা। চলো, আজকের মতো খেলা সাঙ্গ করি। দুজনে দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। মণির ঝকঝকে দাঁতগুলো দুঠোঁটের ফাঁকে ঝলমল করে উঠলো। ক্রমশ
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register