Tue 28 October 2025
Cluster Coding Blog

ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিক সমীরণ সরকার (পর্ব - ১৬)

maro news
ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিক সমীরণ সরকার (পর্ব - ১৬)

তীর্থভূমি বীরভূম, ভ্রমণ তীর্থ বীরভূম

বীরভূম তথা সারা পশ্চিমবাংলায় ইটের তৈরি মন্দির তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ইটের মূল উপাদান ছিল মাটি। এখনকার দিনে যেভাবে একটা নির্দিষ্ট পরিমাপের কাঠের তৈরি আয়তাকার বাক্সের মধ্যে কাদামাটি ভরে কাঁচা ইট তৈরি হয়, আগেকার দিনে ঠিক এভাবে হতো না। প্রথমে ইট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মাটি সংগ্রহ করে, জলে ভিজিয়ে ও ক্রমাগত ওলটপালট করে শক্ত কাদা তৈরি করা হতো। তারপর সেই কাদাকে আগে থেকে পরিষ্কার করে রাখা সমতল প্রাঙ্গনে পুরু করে বিছিয়ে , তার উপরে কাঠের তৈরি 'পিটনে' বা 'পিটনা' দিয়ে ছাদ পেটানোর মত করে পিটিয়ে সমান করা হত। বারংবার বিভিন্নভাবে আঘাত করে কাদামাটিকে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়া হত। ওই উচ্চতা ৩ সেন্টিমিটার থেকে ৫ সেন্টিমিটার এর মতো হতো। এবার ইটের দৈর্ঘ্য প্রস্থের মাপ অনুযায়ী পেটানো কাদামাটির উপর লম্বালম্বি ও আড়াআড়ি সুতো টেনে দাগ দেওয়া হত। তারপর লম্বা সরু বাঁশের আগায় ধারালো ছুরি লাগিয়ে সুতোর দাগ বরাবর কাদার স্তরকে লম্বা ও চওড়া দিকে কাটা হত। এরপর ওই কাঁচা ইট গুলোকে রোদে রেখে উল্টেপাল্টে শুকিয়ে নেওয়া হত। দ্বিতীয় পর্যায়ে ইট ভালো করে শুকিয়ে গেলে সেই ইট গুলোকে কুমোরদের হাঁড়িকুড়ি পোড়াবার মত করে সাজিয়ে নেওয়া হত। পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে তেঁতুল গাছের কাঠ বা কয়েতবেল গাছের কাঠ ব্যবহার করা হত। অম্ল স্বাদ যুক্ত ফলের গাছের কাঠে ইট পোড়ানো হলে লোনা লাগবে না বলে ধারণা ছিল কারিগরদের। তবে প্রয়োজনে অন্য কাঠ ও ব্যবহার করত তারা। মন্দিরের 'টেরাকোটা' ভাস্কর্য করার কাজ থাকলে আধশুকনো মাটির ফলকের উপর ভাস্কর্য খোদাই করে ইটের সঙ্গে সেগুলো পুড়িয়ে নেওয়া হত। ইট তো হলো, এবার প্রয়োজন গাঁথনির উপকরণ। পশ্চিমবাংলার বেশ কয়েকটি পাথরের প্রাচীন মন্দিরে দেখা যায় যেখানে গাঁথনির জন্য কোনরকম পলেস্তরা ব্যবহার করা হয়নি। পাথরগুলো উপর নিচে অথবা পাশাপাশি সাজিয়ে, পাথরকে সন্নিবদ্ধ করে রাখার জন্য প্রয়োজনে লোহার আংটা বা হুক দিয়ে জুড়ে রাখা হত। এরকম পাথরের তৈরি মন্দির বীরভূম জেলার রসা গ্রামে( খয়রাশোল থানা) দেখতে পাওয়া যায়। গাঁথনির উপকরণ হিসেবে কাদা, চুন-সুরকি অথবা চুন বালির মিশ্রণে তৈরি পলেস্তরা ব্যবহার করা হত। চুন সুরকির মিশ্রণ গাঁথনির ‌ উপকরণ হিসেবে অনেক প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহার হতো। সাঁচির মূল স্তুপের গাঁথনিতে চুন সুরকি ব্যবহার করা হয়েছিল। আমাদের দেশে দেশি প্রথায় সুরকি পাওয়া যেত ইট গুঁড়ো করে। বালি সংগ্রহ করা হতো নদীর তীরবর্তী স্থান থেকে। মন্দির তৈরীর স্থপতিরা সুরকি অথবা বালির সঙ্গে অনুপাত অনুযায়ী চুন মেশাতো। পশ্চিমবঙ্গের কোন কোন জায়গায় মাটির সামান্য নিচে শক্ত ডেলার মত একরকম জিনিস পাওয়া যেত। একে 'ঘুটিং' বলা হতো। ওই ঘুটিং একসঙ্গে জড়ো করে পুড়িয়ে চুন পাওয়া যেত। ওই চুন বিশেষ করে গাঁথনির কাজে ব্যবহার করা হতো। এই চুন ছাড়া আর যে চুনের প্রচলন আগে ছিল তা হল 'জোংড়া' বা 'বাখারি' চুন । একপ্রকার শামুকের খোলা পুড়িয়ে যে চুন পাওয়া যেত, তাকে বলা হত 'জোংড়া' চুন। আবার গ্রামাঞ্চলে পুকুরে ডুবায় যে ঝিনুক, গুগলি ইত্যাদি পাওয়া যেত, সেগুলির খোলা পুড়িয়ে তৈরি হতো 'বাখারি 'চুন। এই চুনের জন্য নির্ভর করতে হতো চুনারি সম্প্রদায়ের উপর, যাদের বৃত্তি ছিল শামুক ও ঝিনুকের খোল পুড়িয়ে চুন তৈরি করা। উত্তর ২৪ পরগনার বেড়াচাঁপায় গুপ্ত যুগে একটি মন্দির উৎখনন করার সময় মন্দির চত্বরের কাছেই আবিষ্কৃত হয়েছিল ইট দিয়ে ঘেরা দুটি স্তূপীকৃত আধপোড়া শামুকেরখোলা ও কিছুটা পোড়ানো চুন। গৌড়ে অবস্থিত খ্রিস্টীয় ১৫ শতকের তৈরি একটি মসজিদের গাঁথনির পলেস্তরায় শামুকখোলার চূর্ণ দেখা গেছে। মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা ' কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা' পুস্তকে উল্লেখ করা আছে যে,' যখন পাথুরে চুন ছিল না, ঝিনুক পোড়া চুন বা জোংড়া চুন ছিল। বালি বা সুরকিতে দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি জোংড়া বা বাখারী চুনের সঙ্গে মিশানো হতো গুড় তৈরীর সময় অব্যবহৃত গুড়ের গাদ। তাছাড়া হরিতকি,খয়ের ও মেথির বীজ ভেজানো জল। খ্রিস্টীয় ১৬ শতকে শাস্ত্রবিদ শ্রী কুমার রচিত একটি গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে,' শঙ্খ বা শামুক চূর্ণ, বালুকা, পাকা কলা, মুগ নির্যাস, গুড়গোলা, জায়ফল নির্যাস ইত্যাদি দ্রব্য নিয়ে পঙ্খ-পলেস্তরা মিশ্রণ তৈরি হতো। প্রাচীন মন্দির স্থপতির অনেক বংশধর এর কাছে শোনা গেছে যে, উপরোক্ত উপাদান ছাড়াও রেড়ির তেল, ধুনো ইত্যাদি মিশিয়ে গাঁথনির দেওয়াল মজবুত করা হতো। মেদিনীপুর জেলা কালেক্টরেটের মহাফেজ খানায় রক্ষিত একটি নথিতে দেখা যাচ্ছে যে, একটু সেতু নির্মাণের জন্য ১৩ই জুলাই ১৮১৯ তারিখে গাঁথনির মাল মশলার ফর্দে সুরকির সঙ্গে গুড়, শামুক চুন কলিচুন তেল মেথি হরিতকী পাট প্রভৃতির উল্লেখ আছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, মন্দিরের গর্ভ গৃহের ভেতরের দেওয়াল লেপনের পলেস্তরায় উপাদানের সঙ্গে যে পাটের কুচি মেশানো হতো তার প্রমান বাঁকুড়া জেলার মেটালা গ্রামে( গঙ্গাজলঘাটি থানা) লক্ষীনারায়ণ মন্দিরের দেওয়ালের পলেস্তরায় লক্ষ্য করা যায়। বীরভূম জেলার অনেকগুলি প্রাচীন মন্দির আছে যেগুলি চুন সুরকি নির্মিত। পরবর্তীকালে সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা করব।

চলবে

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register