Tue 28 October 2025
Cluster Coding Blog

গল্পেরা জোনাকি তে সীমন্তীনি দাশগুপ্ত (প্রথম অংশ)

maro news
গল্পেরা জোনাকি তে সীমন্তীনি দাশগুপ্ত (প্রথম অংশ)

অস্তিত্ব

চোখ খুললো ঈশ্বরী। দু-হাতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসলো। কয়েক হাত দূরে পড়ে থাকা চশমাটা নিয়ে পড়লো। তারপর প্রতিদিনের মতোই সকাল সকাল স্নান-খাওয়া সেরে সে ঘর-দোর গোছালো, নিজের জন্য খাবার বানালো আর বাড়ির সামনে তার নিজের হাতে বানানো ছোট্টো বাগানটায় গিয়ে গাছে জল দিলো। আজকাল ঈশ্বরীর কাছে ভালো লাগার দিকের মধ্যে যা যা রয়েছে, সেগুলো হলো রোজ রোজ আর আগের মতো অতগুলো করে হার্টের ওষুধ খেতে হয় না, আর তার আগের অফিসের কাজের ভয়ঙ্কর চাপ থেকে মুক্তি। তাছাড়া, তার রোজকার এই নতুন নিয়মবদ্ধ জীবন তাকে খানিক শান্তিও দেয় বটে। আর কিছু না হোক, তার জীবনের সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণার কথা ভুলিয়ে দেয়।

লাঞ্চ সেরে ঈশ্বরী প্রতিদিনের মতোই তার কফিমাগ ভর্তি করে দোতলার পড়ার ঘরের জানলাটার পাশে গিয়ে বসলো। মেঘ করেছে আকাশে, প্রতিদিনের মতোই। এবছর বর্ষাকাল বড়ো বেশিদিন ধরেই রয়েছে, নাকি শুধু ঈশ্বরীর সময় থমকে গিয়েছে, সে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। তার কাছে যদিও দুটোই এক…

ভীষণ ঝড় উঠলো। পাশের বাড়ির ছেলেটা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করছে, "যে রাতে মোর দুয়ারগুলি..."। কফিমাগটা সরিয়ে রেখে চোখ বুজলো সে। আজ তার অনেক কাজ। তিন মাস ধরে সে আজকের দিনেরই অপেক্ষায় ছিলো। এতটা সময় লাগার কারণ শুধুমাত্র নিজেকে তৈরি করা। আসল সময়ে যেন কোনোভাবেই দুর্বল না হয়ে পড়ে সে, কোনোভাবেই সিদ্ধান্ত থেকে না সরে আসে। ঈশ্বরী ভেবেছিলো যে তার দুর্বলতার কারণ হয়তো হবে সিদ্ধার্থের সাথে কাটানো বারো বছরের অসংখ্য ছোটো বড়ো মুহূর্ত, কিন্তু সময় যত এগিয়ে আসছে, তার মনে হচ্ছে যে হয়তো তার এই প্রতিদিনের অভ্যাস গুলোই তাকে বেশি দুর্বল করে তুলবে। কিন্তু না, সে জানে যে কাজটা তার কাছে কতটা জরুরী। কতটা সময় লেগেছে তার নিজেকে তৈরি করতে, নিজেকে বোঝাতে যে তার অস্তিত্বের কারণ শুধু একটাই।

একটা দমকা হাওয়া দিলো আর সঙ্গে সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। যেন খানিক ঘোরের মধ্যেই এক ছুটে খাড়া-খাড়া সিঁড়িগুলো বেয়ে ছাদে চলে গেল ঈশ্বরী। শুকনো জামাকাপড়গুলো বৃষ্টির জলে ভিজে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে একসাথে তিন-চারটে করে জামা তুলে ছাদের শেডটার নীচে দাঁড়ালো সে। চশমাটা পুরো ঝাপসা হয়ে আছে। কূর্তির কোণা দিয়ে চশমাটা মুছতে মুছতে আবারো সিদ্ধার্থের কথা মনে পড়তে লাগলো তার। ছাদ থেকে জামা-কাপড় তোলার দায়িত্ব ছিল তারই ওপর। আর প্রায়ই সেটা করতে সে ভুলে যাওয়ায় ঈশ্বরীকেই আসতে হতো। আজকের এই বিকেলটা যেন তাকে তিনমাস আগের সেই দিনটার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেদিনও একইরকম ভাবে হুট করে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়। পাশের বাড়ির ছেলেটা ঐ একই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছিলো। তারপরই একইরকম ভাবে তাড়াহুড়ো করে ছাদে উঠে আসতে হয় ঈশ্বরীকে আর ঠিক একই ভাবে তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়... নাহ্, কাজটা আজকেই করবে সে। আর কোনো দ্বন্দ্ব নেই।

রাত তখন ঠিক কটা তার হিসেব নেই। ঈশ্বরী তৈরিই ছিলো। সঙ্গে করে তেমন কিছুই নেওয়ার ছিল না তার। বেরোবার আগে প্রতিটা ঘরে সে একবার করে ঢুকলো, ছাদটা ঘুরে এলো, বাড়ির সামনের বাগানটায় খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়ালো। তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে উল্টোদিকের রাস্তাটায় গিয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো সে। অবশেষে এগিয়ে গেল তার গন্তব্যের দিকে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঈশ্বরী পৌঁছে গেল একটা দোতলা বাড়ির সামনে। খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজা দিয়ে ঢুকেই ডানহাতে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের দিকে। উপরে উঠে কোনো একটা ঘর বেডরুম। তার ওপরের তলায় ছাদ। এর আগে ঈশ্বরীর এই বাড়িতে আসা তারই অন্যান্য অফিস কলিগদের সাথে, গেট টুগেদার উপলক্ষ্যে।

সময় নষ্ট না করে ঈশ্বরী সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল উপরে। প্রথম ঘরটায় ঢুকলো সে। ওটাই বেডরুম। গোটা ঘরটা অন্ধকার, একটা ছোটো নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। আলো খুব কম থাকলেও ঈশ্বরী ভালোই বুঝতে পারলো যে খাটে শুয়ে থাকা শরীরটা কার। বাড়ি কাছাকাছি হওয়ায় বহু বার একসঙ্গেই অফিসে যাতায়াত করেছে তারা। কিন্তু খাটে সে একা। অর্থাৎ যার জন্য ঈশ্বরীর এখানে আসা, সে এই ঘরে নেই। ঈশ্বরীর কী একটা মনে হলো, সে তক্ষুণি বেডরুম থেকে বেরিয়ে সোজা উঠে গেল ছাদে।

ছাদে গিয়ে ঈশ্বরীর হঠাৎ বেশ হাসি পেলো। যা ভেবেছিলো তাই। ছাদের রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থের মুখটা রাস্তার দিকে। একটা প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেট তার ডান হাতের দুটো আঙুলের ফাঁকে ঝুলছে। ঈশ্বরী জানে, এতো রাতে কোনো কিছু নিয়ে খুব ভাবনা চিন্তা করলে তবেই ছাদে গিয়ে সিগারেট খায় সিদ্ধার্থ। বাকি সিগারেটটা ফেলে দিল সে। ঠিক সেই সময়েই পেছন দিক থেকে একটা দমকা হাওয়া এলো আর সিদ্ধার্থ পেছন ফিরলো।

পেছনে ফিরে সিদ্ধার্থের গোটা মুখের ভাবটাই পাল্টে গেল। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার গোটা গায়ে ঘাম জমা শুরু হলো আর সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো। নিজের চোখকে কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না সে। তার গলা বুজে আসছে। টাল সামলাতে না পেরে পেছনের রেলিংটা শক্ত করে ধরে দাঁড়ালো সিদ্ধার্থ। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠলো, "ঈ- ঈ- ঈশ্বরী!"

"ভালো আছো সিদ্ধার্থ?"

"অ- অসম্ভব! এ হতে পারে না!"

সামান্য হেসে উঠলো ঈশ্বরী, "কী হতে পারে না?"

"তুমি- তুমি তো-"

"কতদিন ধরে প্ল্যান করেছিলে সিদ্ধার্থ? বুদ্ধিটা কার ছিল? তোমার? না উত্তরার?"

"না উত্তরা তো-"

"জানতো না। জানি। আমার হার্টের কন্ডিশনের ব্যাপারে উত্তরা কিছুই জানতো না। কিন্তু তুমি জানতে যে এর আগে দু'বার আমার হার্ট অ্যাটাক্ হয়েছিলো। শেষ বারেরটায় একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম। তুমি জানতে যে এরপর যেকোনো একটা মাইনর অ্যাটাক্ এলেই আমি আর বাঁচবো না। তুমি শুধু সময় আর সুযোগের অপেক্ষায় ছিলে।"

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register