Tue 28 October 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব - ২৮)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব - ২৮)

কলকাতার ছড়া 

কালীঘাট কালী হল চৌধুরী সম্পত্তি হালদার পূজক তার এই তো বৃত্তি।।

কালীর শহর কলকাতা। কেউ বলে কালী থেকেই কলকাতা। শহরের আদি দুটি কালীমন্দির হল কালীঘাটে আর চিৎপুরে। কালীঘাট মন্দির হল বড়িশার লক্ষীকান্ত গাঙ্গুলিদের সম্পত্তি। নিজেদের জমিদারির জায়গায় তাঁরাই বানিয়ে দেন মন্দির। সাবর্ণ গোত্রভুক্ত এই জমিদারেরাই রায়চৌধুরী উপাধি পেয়ে পরে হন সাবর্ণ রায়চৌধুরী। কালীঘাট কালীক্ষেত্র। চৌরঙ্গির জঙ্গল পেরিয়েও একসময় দলে দলে মানুষ এসেছে কালীঘাট মন্দির দর্শনে। আর এক তীর্থ চিৎপুর। আজকের গমগমে রাস্তাঘাট। অসংখ্য মানুষের ভিড়। কিন্তু সেযুগে এমনটি ছিল না। তবে কী ছিল সেখানে? কলকাতার অন্যতম প্রাচীন এক তীর্থ। দেবী চিত্তেশ্বরী ও চিতে বা চিত্ত ডাকাতের গা ছমছমে কাহিনী। এই হল চিৎপুরের গোড়ার কথা। সে এক অচেনা কলকাতা। জঙ্গলের মধ্যে চিতে ডাকাতের ডেরা। হা রে রে রে করে মশাল নিয়ে যাত্রীদের লুটপাট করে সে। তার আগে আরাধ্য দেবীর উপাসনা। তার জন্য নরবলি অবধি করতে হাত কাঁপে না চিতের। তার নাম শুনলে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় যাত্রীরা। দেবী দর্শন তো দূর, জঙ্গলের পথও মাড়ায় না সাধারণ মানুষ। ডাকাতি করবার আগে দেবী দুর্গার পুজো করে চিতে। নিজস্ব মহামন্ত্রে পুজো শেষ করবার পর অপরাজেয় হয়ে ওঠে। কিন্তু নিয়তি কেন বাধ্যতেঃ। একদিন পুজো শেষ হবার আগেই জঙ্গল ঘিরে ফেলে গৌড়ের সেনা। আকস্মিক আক্রমণে দিসেহারা চিতের মৃত্যু হয় জঙ্গলেই। কিন্তু তারপর কী হল তার আরাধ্য দুর্গামূর্তির? সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। এরপর চিৎপুরের গঙ্গাতীরে আসেন দশমহাবিদ্যার অন্তর্গত তারা মায়ের সাধক নৃসিংহ ব্রহ্মচারী। চিৎপুরের গভীর জঙ্গলই হয়ে ওঠে তার সাধনপীঠ। তখন সেই জায়গা শেওড়াফুলীর রায় জমিদারদের জমিদারীর মধ্যে পড়ে। সেই বাড়ির সঙ্গেই বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন মুর্শিদাবাদে কুলাই গ্রামের জমিদার মনোহর ঘোষ। শোনা যায় তিনি আবার বিখ্যাত চৈতন্য পার্ষদ বাসুদেব ঘোষের বংশধর। তখন তিনি মুঘল কর্মচারী হিসাবে জরিপের কাজ করেন রাজা টোডরমলের অধীনে। বিবাহসূত্রে শেওড়াফুলী রাজবাড়ীর জামাই হিসাবে তিনিই পেলেন চিৎপুরের জমি সত্ত্ব। আর তারপরেই মহাত্মা নৃসিংহ ব্রহ্মচারীকে ৩৬ বিঘা জমিদান করেন তিনি। আর তখনই জঙ্গল পরিস্কার করতে করতে আবার উদ্ধার হন চিতে ডাকাতের দেবী শ্রী শ্রী জয়চণ্ডি চিত্তেশ্বরী দুর্গামাতা। মন্দির প্রতিষ্ঠা করে আবার নৃসিংহ ব্রহ্মচারীর কাছ থেকে পুজো পেতে শুরু করেন দেবী। শুরু হয় দেবী চিত্তেশ্বরীর নতুন আখ্যান। গড়ে উঠতে শুরু করে চিৎপুর। জঙ্গল পরিস্কার করে তৈরি হয় রাস্তা। পরে সেটিই গঙ্গার পাড় বরাবর শহর কলকাতার তীর্থযাত্রীদের কাছে ব্যস্ত রাস্তা চিৎপুর রোড।

দেবী চিত্তেশ্বরীর সাথে জড়িয়ে যায় মনোহর ঘোষের নাম। কিন্তু বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করে দেন কাশীপুরের কালীকৃষ্ণ দেববাহাদুর। মনোহর ঘোষের স্ত্রীয়ের দান করা জমিতে নির্মাণ হয় মন্দির৷ সেখানেই স্থায়ী ভাবে নৃসিংহ ব্রহ্মচারীর হাতে পূজিত হন জয়চণ্ডি দুর্গা। এরপর মন্দিরের সাথে জুড়ে যায় কলকাতার ব্ল্যাক জমিদার গোবিন্দরাম মিত্রের নামও। পুরনো মন্দিরকে আবার নতুন করে সংস্কার করেন তিনিই। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সেই মন্দিরেই রয়েছেন কলকাতার অন্যতম প্রাচীন দুর্গা বিগ্রহ। সিংহবাহিনী দেবী। কিন্তু সিংহের ঘোটক মুখ। চিতে ডাকাতের দুর্গার সিংহ ঘোটক মুখ কিকরে হল তা নিয়ে মতান্তর বিস্তর। ভাবা হয় দেবী পরে বৈষ্ণব জমিদারদের পূজিতা হয়েছেন বলেই সিংহমুখ পরিবর্তিত হয় ঘোড়ায়।কালীঘাট ও চিত্তেশ্বরীর মন্দিরই কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন দুই ধর্মক্ষেত্র। মন্দিরের ওপরে আজও প্রতিষ্ঠাকাল হিসাবে উল্লেখ আছে ১৬১০ সালের।  অর্থাৎ প্রায় ৪০০ বছর জুড়ে কলকাতার ইতিহাসে আষ্টেপৃষ্টে জুড়ে আছে দেবী জয়চণ্ডী চিত্তেশ্বরী দুর্গামাতার নাম। উত্তরের জনকোলাহল কাশীপুরে আজও দলে দলে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে চিত্তেশ্বরী মন্দিরে। বিটি রোডে চিড়িয়ার মোড় থেকে পশ্চিমে গঙ্গাতীরে কাশীপুরে গান শেল ফ্যাক্টরির পাশে চিতে ডাকাতের প্রাচীন দুর্গার সাথে আজও রয়ে গেছে সেই হারিয়ে যাওয়া একখণ্ড জঙ্গলাকীর্ণ কলকাতা। আর আজকের চিতপুরের সাথে মিশে আছে দুর্ধর্ষ চিতে ডাকাতের নাম। আজ চিতপুরের ব্যস্ত ও জনকোলাহলের মধ্যে আর শোনা যায় না সেই ভয়াল হুঙ্কার। কিন্তু তার মধ্যেই রয়ে গেছে সেই হাড় হিম করা অসংখ্য আখ্যান।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register