- 8
- 0

এরমধ্যেই ঘটে গেল আর এক অঘটন। ১৮১৩ সালে হঠাৎ পরলোক গমন করলেন কেরী সাহেবের মুন্সী রামরাম বসু। শ্রীরামপুর মিশন ও বাঙালীদের মধ্যে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। প্রেসেও পড়ে থাকতেন রাতদিন। কর্মযোগী মানুষ। স্বভাবতই তাঁর মৃত্যু খ্রীষ্টান বাঙালী সমাজে এনে দিন এক মহাশূন্যতা।
উইলিয়াম কেরীসাহেব ছিলেন উদ্ভিদপ্রেমিক। কলকাতার অন্যপারে হাওড়ায় কোম্পানির বাগানের (বর্তমানে শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন) সুপারিন্টেন্ডেন্ট রক্সবরো সাহেবের মৃত্যুর পর সম্পূর্ণ বাগানটির দায়িত্ব আসে তাঁর হাতে। গাছপালা নিয়ে তাঁর ছিল সীমাহীন আগ্রহ। বাগানের বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদজগতের সমস্ত প্রকার গাছের একটি তালিকা তিনি ছেপে প্রথম প্রকাশ করেন প্রায় একক উদ্যোগেই। গঙ্গাতীরে কোম্পানির এই উদ্ভিদ বাগানের তখন খুব নামডাক। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মূল্যবান সব গাছ এনে বসিয়েছিলেন প্রথমে বিখ্যাত রবার্ট কিড সাহেব এবং পরে বিখ্যাত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী রক্সবরো সাহেব। কোম্পানির সেনাবাহিনীতে মেজর পদ নিয়ে এদেশে এসেছিলেন কিড সাহেব। প্রথম জীবনে সেনাবাহিনী সূত্রে আসাম, ভূটান ঘুরলেও পরে হন জাহাজঘাটার সেক্রেটারি। আজকের 'খিদিরপুর' আসলে তাঁর নাম থেকেই (কিডের পুর)। নিজের উদ্ভিদপ্রেমী মনটার প্রশ্রয়ে তিনিই জমি খুঁজে তৈরি করে দিয়েছিলেন 'অনারেবল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিস বোটানিক গার্ডেন, ক্যালকাটা'। লোকমুখে 'কোম্পানির বাগান'। আর সময়ের চাকায় গড়িয়ে সারা দুনিয়ার গাছসমৃদ্ধ এই বাগান এসে পড়ে আর এক উদ্ভিদপ্রেমী কেরী সাহেবের হাতে। সমস্ত গাছের স্বার্থে অগাধ পরিশ্রম করে তিনিও সাজিয়ে তুললেন বাগানকে। একা প্রায় ৩২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ সংগ্রহ করে রোপণ করা তাঁর মতো কিংবদন্তি উদ্ভিদপ্রেমিকের দ্বারাই সম্ভব।
শ্রীরামপুরে রমরম করে চলল প্রেস। ছাপা হল বহু ভাষার বই। সুতরাং সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে সংবাদপত্র ও পত্রিকা ছাপার কথাও চিন্তা করলেন কেরী সাহেব। যে পত্রিকা সাধারণ বাঙালীর ঘরে বাংলা ভাষায় তুলে ধরবে সামাজিক ছবি। গদ্যের সহজ আকারে পরিবেশন করবে খবর। ১৮১৮ সালের ২৩শে মার্চ প্রথম শ্রীরামপুর থেকে কেরী সাহেবের সম্পাদনায় প্রকাশিত হল সাপ্তাহিকীপত্র 'সমাচার দর্পণ'। এরপরই প্রকাশিত হল আরও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সংবাদপত্র। মার্শম্যান সাহেবের হাত ধরে ছাপা হয় 'ফ্রেন্ডস অফ ইণ্ডিয়া' নামক ইংরাজি পত্রিকা। প্রকাশিত হয় দিগদর্শন, পেনী, সাটার ডে ম্যাগাজিনের মতো বিখ্যাত সব সংবাদপত্র। এরপর কেরী সাহেবের হাত ধরেই হিন্দী, তেলেগু ও সংস্কৃত ভাষায় প্রকাশ হয় একাধিক পত্রিকা। এরপরই ১৮১৯ সালে বাবুরাম নামে এক ব্যক্তি ইংরেজ মুদ্রণবিভাগের প্রধান কোলব্রুকের সাহায্যে কলকাতায় প্রথম মুদ্রণযন্ত্র বসান। তারপরই কলকাতার বুকেও ছড়িয়ে পড়ে ছাপাখানা তৈরির উদ্যোগ। বিভিন্ন জায়গায় ডাক পড়ে উইলিয়াম কেরী সাহেবের। তিনিও যত্ন করে, হাতে ধরে শেখাতে থাকেন এতবড় একখানা উদ্যোগের পিছনে লুকিয়ে থাকা সমস্ত চাবিকাঠি। শ্রীরামপুরের হাত ধরেই বই ছাপার বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে বাঙালী।
0 Comments.