Thu 30 October 2025
Cluster Coding Blog

T3 || স্বাধীনতার খোঁজে || 26য় নবনীতা চট্টোপাধ্যায়

maro news
T3 || স্বাধীনতার খোঁজে || 26য় নবনীতা চট্টোপাধ্যায়

মানভূম জননী, লাবণ্যপ্রভা দেবী

দীর্ঘ ১০৬ বৎসর তিনি বেঁচে ছিলেন অথচ তাঁর এই দীর্ঘ জীবন পুরোটাই কেটেছে দারিদ্রপীড়িত হয়ে| লাবন্য প্রভা ঘোষ, গান্ধীবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী বাঙালী রমণী, যিনি পরিচিত মানভূম জননী হিসাবে| তাঁর নামে কোনো স্টাচু নেই. কোনো স্মারক নেই, এমন কি তাঁর কোনো ফটোগ্রাফ ও পাওয়া যায় না| শপিং মল, লং ড্রাইভ, ইন্টারনেটের ঘূর্ণাবর্তে ছুটতে ছুটতে আমরা ভুলেই গেছি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আলোড়ন তোলা এই মহিয়সী নক্ষত্রকে| ১৮৯৭ সালে পুরুলিয়ার একটি ছোট গ্রামে তাঁর জন্ম হয়েছিল| বাবা নিবারণ চন্দ্র দাশগুপ্ত ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং পুরুলিয়া জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক| বাবা প্রধান শিক্ষক হওয়া সত্তেও লাবন্য প্রভা দেবিকে কোনদিন স্কুলে পাঠানো হয়নি| বাড়ীতেই বাবার কাছে তাঁর শিক্ষা শুরু হয়| মাত্র এগারো বৎসর বয়সে তাঁর বিবাহ দেওয়া হল স্বাধীনতা সংগ্রামী অতুল চন্দ্র ঘোষের সাথে| যে পরিবারে তিনি জন্মেছিলেন তা ছিল পুরুলিয়ার একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবার, বিবাহ সূত্রেও যুক্ত হলেন আরো এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবনের সাথে| ফলে দেশকে স্বাধীন করার যজ্ঞে তিনি যে আজীবন আগুয়ান হবেন এতো বলাই বাহুল্য| তাঁর পুরো পরিবারের সাথে তিনিও গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন| ১৯২১ খৃ: গান্ধীজির ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করে লাবন্যপ্রভাদেবির পিতা কারারুদ্ধ হলেন| বহুদিন পর জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি তাঁর জামাই অতুল ঘোষের সাথে পুরুলিয়ার তেলকল পাড়ায় শিল্পাশ্রম নামে একটি সংস্থা গঠন করলেন| মূলত: শিল্পাশ্রম ছিল ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল কংগ্রেসের সদস্যদের ও বিপ্লবীদের সভাকেন্দ্র| লাবন্যপ্রভা দেবি প্রথম থেকেই শিল্পাশ্রমের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন|শিল্পাশ্রমে বহু বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী ও নেতা সুভাষ চন্দ্র বোস, চিত্তরঞ্জন দা, মহাত্মা গান্ধী এসেছিলেন| মানভূমে শিল্পাশ্রম ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল| এই আশ্রমের বিভিন্ন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে লাবন্যপ্রভা দেবি তিন বার গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন| ১৯৩০ সালে গান্ধীজির লবণ আন্দোলনে যোগদান করে তিনি পুরুলিয়ায় সত্যাগ্রহ পতাকা হাতে নিয়ে স্থানীয় বিভিন্ন জায়গায় তিনি লবণ আন্দোলনের সমর্থনে আন্দোলন করেন| এর আগেই ১৯২৬ সালে তিনি মানভূম জেলার জেলা কংগ্রেস কমিটির নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়েছিলেন| লবণ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার জন্য তাঁকে ব্রিটিশ সরকার একাধিকবার কারারুদ্ধ করে| এছাড়াও ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ও তাঁর বৈপ্লবিক কার্যকলাপে এবং গুরুত্ব পূর্ণ অংশগ্রহণে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে| ১৯২৫ সালে লাবণ্য প্রভা দেবির পিতা মুক্তি নামে একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করেন| পরবর্তী কালে লাবণ্য দেবি এই সংবাদ পত্রের সম্পাদক হিসাবে বহু প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের উপরে | সেইসব আগুন ঝরানো লেখনী বহু তরুণ তরুণীকে স্বদেশী সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছিল| দেশ স্বাধীন হল কিন্তু তাঁর লড়াই থামল না| ১৯৪৭ খৃ: দেশ স্বাধীন হবার পর মানভূম জেলা বিহার রাজ্যের সাথে যুক্ত হয়| তদানীন্তন বিহার সরকার মানভূমে বাংলা ভাষা ব্যবহারের উপর কড়া বিধি নিষেধ আরোপ করলেন| মানভূমের বাঙালি অধিবাসীদের নিয়ে লাবণ্য প্রভা দেবি ভাষা আন্দোলন শুরু করলেন| ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৬ সাল অবধি বহু প্রতিবাদ, ধর্ণা, টুসু সত্যাগ্রহ, পুরুলিয়া থেকে কলকাতায় প্রতিবাদ অভিযানের মাধ্যমে তিনি দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে বিরাট আলোড়ন এনেছিলেন| এর জন্য তিনি গ্রেপ্তার ও হয়েছিলেন| কিন্তু তাঁর ভাষা আন্দোলন এতটাই অপ্রতিরোধ্য ছিল যে শেষ পর্যন্ত সরকার ১৯৫৬ সালে মানভূম জেলাকে আবার পশ্চিমবঙ্গের সাথে যুক্ত করেন| ভাষা আন্দোলনে তাঁর বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৫৭ খৃ: তাঁকে এম এল এ করা হয়| কিন্তু এর অল্প কিছুদিন পরেই তিনি রাজনৈতিক জীবন থেমে বিদায় নেন| এরপর এক সুদীর্ঘ জীবন তিনি অতিবাহিত করেছেন নীরবে| ১৯৭৫ সালে জরুরী অবস্থার সময় তাঁকে আরো একবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বিনা কারণে| তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে তিনি পান নি কোনো স্বীকৃতস্বীকৃতি, সম্মানপত্র, কোনো সাহায্য| একদা যে সাহসী নারী দেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবনের সব কিছু তুচ্ছ করে আগুন ঝরা বিপ্লবের, প্রতিবাদের পথে হেঁটে ছিলেন, দেশবাসীর পাশে ছিলেন সমস্ত অন্যায় অবিচারের প্রতিরোধ হিসাবে, চরম দৈন্য দুর্দশায়, শারীরিক অসুস্থতায়, অবহেলায় নীরবে কাটিয়ে গেলেন ১০৬ বৎসরের এক দীর্ঘ জীবন পথ| ২০০৩ সালে তাঁর জীবনের অন্তিম বছরে প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভাষা শহীদ স্মারক সমিতির পক্ষ থেকে ভাষা আন্দোলনে তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন| সম্ভবত: এটাই ছিল তাঁর একমাত্র প্রাপ্ত সম্মান|
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register