Wed 29 October 2025
Cluster Coding Blog

গল্পে সিরাজুল ইসলাম

maro news
গল্পে সিরাজুল ইসলাম

শাপলা ভাবী

"আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল, আমি অহনা বলছি। আমার আম্মু ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক করে কয়েকমাস আগে মারা গেছেন!"

দুপুরে নামাজ আদায় করে ভাতঘুম দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে স্বভাবসুলভ আচরণে মোবাইলটা তুলে মেসেজ চেক করছি। হঠাৎই আমার হোয়াটসঅ্যাপ একটা অতীব ক্ষুদ্র মেসেজটা এলো নীরবে নিঃশব্দে। যে নাম্বার থেকে সেটা এলো, সে নাম্বারটা বহুদিন যোগাযোগ করে না। কখনোসখনো করতো। তাও মামুলি দু'একটা হাই হ্যালো, কিম্বা কেমন আছো, ভালো আছিতেই শেষ করে সরে থাকতো সেই নিভৃতচারিনী। আমার বেশ অভিমান হতো। অভিমান হতো কিশোরবেলার দিনগুলোর করুণঘন আবেগ মাখানো সময়ের হাত ধরে। ভাবতাম মানুষ কেন পাষাণ হবে। কেন এমন করে সরে থাকবে। ফলে সেই আবেগাপ্লুত কষ্টে আমিও সরে গেছি কবে।

আজকের মেসেজ পড়ে বুকের ভেতর কষ্টগুলো দ্রবীভুত হয়ে তপ্ত লোনাজল দুচোখের কার্নিশে এসে জমা হয়ে গেছে। ঠিক যেভাবে নিশির শিশির ঝরে পড়ে থমকে থাকে শিরীষের ডালে। আমার সে মর্মবেদনা বোঝানোর সংজ্ঞা জানা নেই। প্রতিনিয়তঃ কত স্বজনের মৃত্যুবার্তা আসছে এই সেলফোনে। নিয়ম নিগুঢ়ে দিনগত আয়ুক্ষয় হয়ে গেছে পরিচিত আত্মীয় অনাত্মীয় বন্ধু স্বজনের। এতো ব্যথা টের পাই নি সেসবে। প্রথাগত ভাবে তাঁদের মুখগুলো ডিলিট হয়ে গিয়েছে। ইরেজার ঘষে মুছে দিয়েছি সেল-নম্বর।

আজকে কেন বারবার দুচোখের পাতা ভরে জল আসছে! কেন এমনকরে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার হৃদয়আকাশ! কেন এমন করে সকরুণ সুরে বিদীর্ণ করে দিয়ে যাচ্ছে বেহাগের সপ্তমী সুর!

সে অ নে ক আগের কথা। হয়তো ১৯৮০/৮১ হবে। সদ্য বিয়ে হয়েছে মেজদির। দূরের পথ বলেই বাবা-মাকে বলে কয়ে একদিন রেলগাড়ী চড়ে পৌঁছে গেছি মেজদিদির শ্বশুরবাড়ী। আর পাশে ছিলো আমার শাপলা ভাবীর শ্বশুরবাড়ী। পাশাপাশি দু'বাড়ীর সুসম্পর্ক না থাকলেও নতুন বৌয়ের কারণে সম্পর্কে ফাটলটা কমে এলো।

শাপলা ভাবীকে দেখতে সদ্যফোটা পদ্মের মত। মুখশ্রীটাতে সারাক্ষণ জড়িয়ে আছে সুমিষ্ট হাসি, এতো খুশি ছড়ানো সে হাসি দেখে মুগ্ধ হই। আমার বোকাসোকা হাবাগোবা চেহারাটা দেখে ভাবী বেশ মজা করে আমার সাথে। বয়সের বড় হবে হয়তো দু এক বছরের।মেজদির বয়সী হবে। আমার সাথে ভাব হতে খুব দেরি হলো না ভাবীর হাসিখুশী খুনসুটিতে সময় কাটে আমাদের। এতো প্রাণবন্ত আড্ডা। প্রাণখোলা হাসি দেখে মন ভরে যায়। ভাবীকে খুব আপন মনে হয়। বলি, তুমি কি ভিনগ্রহের কোন অপ্সরী! পথ ভুল করে চলে এসেছো এই মর্তালোকে! শুনে স্মিত হাসতে হাসতে কান্না ভরা চোখে চেয়ে থাকে। তিনিও এমনটাই বলেছিলেন আমার হাতধরে। মায়ের মমতা জড়ানো বন্ধু আমার। বোনের আদরের লক্ষ্মী প্রিয়জনা স্নেহময়ী শাপলা ভাবী।

বড়লোক বাবার পরমাসুন্দরী কন্যাকে স্কুলপথে প্রতিনিয়তঃ তিতিবিরক্ত করতো বখাটেের দল। তাদের হাত থেকে রক্ষা করে তুলে নিয়ে বিয়ে করে এলাকার ডাকসাইটের জাদরেল সে ভাই। পরিবারের অমতে বিয়ে করার কারণে বহুদিন বাবার ঘরে ফিরে যেতে পারেনি ভাবী আমার। এভাবে অ নেক বছর। সন্তানের জন্ম দিতে অপরাগ বউয়ের ঠাঁই হয় নি এই ঘরের কোণে। ফিরে গিয়েছেন তিনি তাঁর বাবাবাড়িতে এরপর। দেখা হয়নি আর আমাদের। খোঁজই পাই নি। যান্ত্রিক সভ্যতার যাপিতজীবনে অশ্বখুরে ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলা মানুষের ভীড়। শুশুক ব্যস্ত জীবনের গন্ডিতে দাঁড়িয়ে কে কোথায় কখন হারিয়েছে কে তা ঠিক করে বলতে পারে।

কাহিনী এখানেই শেষ করে দিলে ভালো হবে। কিন্তু বিধান লেখা ভিন্ন।

প্রায় তিরিশ বছর পর রেলওয়ে জংশন ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি কাউকে বিদায় দেবো বলে ষ্টেশনের প্রথম শ্রেণীর যাত্রী বিশ্রামাগার থেকে দু'টো ফুটফুটে কন্যা সন্তান সাথে নিয়ে এক রূপবতী বেরিয়ে এসেছে। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সুডৌল মুখ। সেদিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকলে বুকের ভেতর কষ্ট হয়। তিনি হাত ইশারায় কাছে ডাকলেন। ---আমরা কি পরিচিত! ---কোথাও কি এর আগে দেখা হয়েছে! ---কোন সাহিত্য আসর কিম্বা কোন সেমিনারে?

সব প্রশ্নের উত্তর এলো, "না।" তবুও কেন যেন মনে মনে, মুখটা খু উ ব চেনা। যেন কতদিনের পরিচয় আমাদের। কে জানে! ফিরে যাবো। সহসা তিনি আমার নাম ঠিকানা জানতে চাইলেন। বিব্রতবোধ করতে থাকি। তবুও বলি সব পরিচয় পরিচয়ের সৌজন্যতায়। সলাজ হাসি ছড়িয়ে পড়লো তাঁর মুখে। আগের মতন তেমনি মমতাভরে হেসে তিনি তাঁর নাম বলেন। বললেন, এখন চিনতে পেরেছো! অবাক বিস্ময়ে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে দেখি পবিত্র মুখটা চিকন দোহারা চেহারাটা একটু স্থুলকায় হয়েছে। বিলাসবহুল জীবনের মানুষ হিসেবে সমাজে ঠাঁই। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকি আমি তাঁর মুখের দিকে। কখন যেন দুফোঁটা জল গড়িয়েছে আমার দু'গন্ড বেয়ে। বয়সী মানুষের সাথে যা মানানসই নয়। স্নেহার্দ্র কন্ঠে তিনি তার সাথে যোগাযোগ রাখার কথা জানাতেই রেলগাড়ী পৌঁছে গেছে। চলে গেলেন তারা সপরিবারে দক্ষিণ বাংলা রূপসুধা দেখার অবকাশ যাপনে।

এরও অনেকদিন পর একদিন সেলফোনে মেসেজ এলো। তিনি ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে অবস্থান করছেন। তাঁর বর্তমান স্বামীর কর্মক্ষেত্রে। বললাম দশ মিনিট সময় দিলেও তো দেখা হতো।

দেখা হয়নি আমার। এখনাকার কর্ম শেষ। পদোন্নতির শীর্ষধাপে তাঁর স্বামীকে সাথে নিয়ে রাজধানীতে বিশাল বাড়িতে আছেন। মাসে ছমাসে বিদেশে চলে যান। মেয়েরা বড় হয়ে গেছে। উন্নত দেশে পড়াশোনা নিয়ে যে যার অবস্থানে ব্যতিব্যস্ত। শাপলা ভাবীর সময়ের বড্ড অভাব বলেই তিনি সময় দিতে পারেন না আর। তারপরও হোয়াটসআ্যাপে জানাতেন, সময় পেলে রাজধানীতে এসো। এসে দেখে যেও তোমার ভাবীর গোছানো গেরস্থালী সংসার।

সময় বডড নিষ্ঠুর। সময় হয়নি আজও আমার।

আস্তে আস্তে আমিও ভুলে গেছি সেই প্রিয় মুখ। অনেক কথার জবাবগুলো পাওয়া যায়নি আর কখনও। ভাদরের শেষ বিকেলে উদাসী বৃষ্টিতে ভিজে একাকার আদিগন্ত চরাচর। নিটোলজলে ভেসে আসে শুধু শাপলা ভাবীর পবিত্র মুখটা।

জাজাকাল্লাহ খাইরান ফা-ইন্নাল্লাহা শাকিরুণ। পবিত্রতার প্রতীক হিসাবে সন্মাননা রেখে গেলাম ভাবী আমার। মহান আল্লাহর কাছে একটা দাবী তোমাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন। আমিন। সুম্মা আমিন।

শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা থাকলো। মহান আল্লাহ তাঁর রহমতে শোক কাটিয়ে ওঠার তৌফিকতা দান করুন, সে দোয়া দরখাস্ত রইল।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register