Wed 29 October 2025
Cluster Coding Blog

মুক্তগদ্যে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

maro news
মুক্তগদ্যে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

চায়ের দোকান চাই-ই চাই

কতকিছু যে লাগে মানুষের! দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রয়োজনের শেষ নেই। শুধু প্রাণ ধারণের জন্য অন্ন বস্ত্র বাসস্থান ইত্যাদি পেলেই তো হলোনা। চাই আরও অনেক কিছু। হয়তো এমন নয় যে তা না পেলে প্রাণটাই টিকবেনা। কিন্তু প্রাণ তো শুধু টিকিয়ে রাখার জন্য নয়। তাকে আটপৌরে ব্যবস্থাপনায় মিশিয়ে নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে হয়। তবেই না জীবন! তার দিনযাপনের একটা শুরু আছে। একটা ছন্দ আছে। দিনটাকে যদি ঠিক ছন্দে শুরু করতে হয় তাহলে সকালেই চাই এক কাপ গরম চা। শুধু কি সকালে? অনেকের হয়তো সারাদিনে আর দরকার হয়না। আবার অনেকের আরও কয়েকবার চাই। যার যেমন অভ্যাস। সেই অনুযায়ী দিনের এক একটি সময় নির্দিষ্ট করা থাকে। একটু চা না হলে যেন সেই সেই সময়গুলো থমকে যায়। আবার অযাচিত ভাবে এলেও তাকে উপেক্ষা করা যায়না।

বাড়িতে থাকার সময়টুকু নাহয় একরকম। কিন্তু যখন কাজে বা অকাজে বাইরে অনেকটা সময় কাটাতে হয়, আর চায়ের দরকার হয়, তখন? তার জন্যই আছে চায়ের দোকান। কে কবে কোথায় প্রথম চায়ের দোকান শুরু করেছিল জানা নেই, কিন্তু রাস্তার মোড়, শহরের ফুটপাথ, জমজমাট গাছতলা, অপেক্ষার বাসস্টপ, স্টেশন – এসব জায়গায় একটাও চায়ের দোকান থাকবেনা তা হয়না। না থাকলে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। হাট বাজারের কথা আলাদা। সেখানে অবধারিত নিয়মেই থাকবে অনেকগুলো চায়ের দোকান। বেচাকেনা করতে আসা মানুষেরা সেখানে চা খেতে খেতে জমিয়ে গল্প করবে, কাজের কথা বলবে, সেটাই স্বাভাবিক।

স্টেশনে যাবার জন্য ভোরবেলা দিনের প্রথম যে বাসটি ছেড়ে যাবে বাস স্ট্যান্ড থেকে, যখন দিনের আলো ফোটেনি, চারদিক অন্ধকার, সময়টা হয়তো শীতকাল, ঠাণ্ডা হাওয়ায় কাঁপুনি দিচ্ছে সারা শরীরে, তখন এক কাপ গরম চা না হলে হয়? সেখানে কোনও চা বিক্রেতা নেই এমনটা সাধারণত হয়না। সময় মানুষকে ঠিক জুটিয়ে দেয়। দেখা যায় কেউ না কেউ উনুন বা স্টোভ জ্বালিয়ে চা বানাচ্ছে আর তাকে ঘিরে আছে ক্রেতারা। স্টেশনেও তাই। সেখানটা হয়তো আর একটু জমজমাট, আরও বেশি দোকান, আরও বেশি লোকজন। কিন্তু সবটাই চা-কেন্দ্রিক। যেমন দেখা যায় হাইওয়ের ধারে। লম্বা জার্নির মাঝে একটু থেমে একটু চা খেয়ে নিলে আবার নতুন এনার্জি আসে। যাত্রাপথ আনন্দের হয়। অনেকের সঙ্গে ফ্লাস্কের মধ্যে চা বা কফি থাকে। কিন্তু সেই চায়ে কী যেন একটা পাওয়া যায়না, যা রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে খেলে পাওয়া যায়। আসলে ঘরে তৈরি চা, আর দোকানের চা, চিরদিনই আলাদা।

তাই সকালে বাজারে গিয়ে বাজার করার আগে বা পরে হলেও অনেকেই একবার চায়ের দোকানে গিয়ে থিতু হয়। আরও অনেকের মাঝে ছোট ‘কাঁচের গেলাসে’ ভাপ উঠতে থাকা চায়ে চুমুক দিয়ে সেই যে তৃপ্তি, ঘরের চায়ে তা কোথায়? ভাবখানা যেন এই যে, সেই চা না খেলে আর বাজার যাওয়া কেন?

শুধু কি বাজার? সকালে বাচ্চাদের স্কুলে দিতে যাওয়ার সময়? ছেলেমেয়েরা গেটের ভিতরে ঢুকে গেল, ব্যস তার পরেই একা কিম্বা কয়েকজন মিলে পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ানো চায়ের দোকানের সামনে। দোকানদার জানে কার কিরকম পছন্দ। কে শুধু চা আর কে সঙ্গে নেবে কোন বিস্কুট। পুরুষ, মহিলা মিলে যার যার নিজের নিজের জটলায় গল্পে ব্যস্ত। জানে, দোকানদার ঠিক সময়ে হাতে তুলে দেবে গরম চা। একটু অসাবধানে মুখ দিলেই ঠোঁট পুড়ে ফোস্কা। শেষ চুমুকের পর ভাঁড় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যে যার বাড়ির পথে। এই সাময়িক আড্ডা, এই ছোট্ট একটুখানি বিরতি, এগুলো খুব দরকার। চায়ের দোকান না থাকলে কে মেটাত এই দাবি?

আসলে চায়ের দোকান নিছক দোকান নয়, নিজেকে একটু চাঙ্গা করে নেওয়ার জায়গা। চেনা অচেনা মানুষের একটা মিলনকেন্দ্র। যার যেমন পরিচিতি বা চায়ের গুণমান, তার তেমন ব্যবসা। পথচলতি মানুষের কাছে যেমন খুব কম খরচায় একটু এনার্জি নেওয়ার সুযোগ, তেমনি আবার হাজারও কথার আঁতুড়ঘর। খবরের কাঁটাছেঁড়া আর গল্প আড্ডা ও তর্কের পীঠস্থান। সেখান থেকে কখনো পাওয়া যায় দরকারি কোনো পরামর্শও, আবার কখনো হয়তো বেরিয়ে আসে অনেক জটিল বিষয়ের সমাধানও।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register