Wed 29 October 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব - ২৫)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব - ২৫)
শহরতলির ইতিকথা
রাতে কলেজ বলে, সন্ধ্যায় ট্যুইশান করতে পারে না, আবার সকালে আটটা থেকে যে বাড়িতে পড়ায়, তারা চান-টান করে রেডি হয়ে পড়তে বসে; ওদের রাজীব পড়াচ্ছে বহুদিন ধরে, সেই নিজের স্কুল-ফাইন্যাল পাশ করার পর থেকেই, তাই একটা টান দু'দিক থেকেই গড়ে উঠেছে; পৌনে দশটায় ওদের ছেড়ে দিতে হয়; ওরা, তারপর খেয়ে-দেয়ে, স্কুল যায়। রাজীবের একটু অস্বস্তি হয়, কারন, সে ঠিক নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারছে না বলে মনে মনে একটা অস্বস্তি অনুভব করে; আবার, ওরাও, রাজীব ছাড়া, অন্য টিউটরের কাছে পড়তে রাজি নয়, তাই গ্রীষ্মের ছুটিতে কলেজ বন্ধ থাকায়, রাজীব ওদের সন্ধ্যাতেই যতটা সম্ভব পড়িয়ে, নিজের মনের অস্বস্তিভাবটা কাটাচ্ছে।

একদিন সন্ধ্যাবেলায় খামারপাড়া অঞ্চলের ঐ বাড়িতে পড়াচ্ছে;ওদের পাড়ার এক দাদুর, আজ-যায়-কাল যায় অবস্থা। পাড়ার যে বন্ধুর মামার বাড়ি নৈহাটিতে, যে বাড়িতে সে আইএ (কমার্স) পড়ার সময় কলেজের পরীক্ষা চলা কালে অনেক দিনই থেকেছে , সেই বন্ধুর দাদুই আজ ইহলোক ছাড়ার পথে। দাদু, অনেক দুঃখ -কষ্ট সহে,নাতিদের সাবালকত্বে পৌছে দিয়ে আজ পরপারের পথে। দাদুর দুই পুত্র, অর্থাৎ বন্ধুর বাবা ও জেঠামশাই, দুজনেই প্রৌঢ়ত্বে পাগল হয়েছে; দোতলার একটা ঘরে বন্ধুর বাবাকে আটকে রাখা হতো। জেঠা, বেশিদিন জীবিত ছিলেন না, রাজীবরা, তাঁকে দেখেনি; জেঠিমা ও জেঠতুতো দিদিকে দেখেছে; ঐ দিদির বিয়েও দাদু, বেশ ভালো ঘরেই দিয়েছেন; দাদুর আর্থিক অবস্থা তো ভালোই, শুধু সন্তানযোগটা মোটেই অনুকূল ছিল না। বন্ধুর বাবাকে, দোতলার একটা ঘরে, বাইরে থেকে শিকল দিয়ে আটক রাখা হতো; তিনিও বেশ কয়েক বছর হল দেহ রেখেছেন। ওদের মেশোরা, বন্ধুকে আই-এ পরীক্ষার পরই একটা ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন; দাদু, এবার পরম নিশ্চিন্তে বড় নাতি গোরাও ছোট কৃষ্ণকে রেখে যাচ্ছেন, দু'জনেই এখন সাবালক। বন্ধুর মা, দাদুর মৃত্যুর সংবাদ, নৈহাটির মামাদের কাছে পৌছে দেবার জন্য,পাড়ার একজনকে রাজীবের কাছে পাঠিয়েছেন। রাজীব, পড়ানো ছেড়ে, সাইকেল নিয়ে তড়িঘড়ি, নৈহাটির অভিমুখে রওনা হল।

চুঁচুড়ার লঞ্চঘাটে, সাইকেল রেখে, লঞ্চ ধরে নৈহাটি গিয়ে, গোরার মামার বাড়িতে খবরটা দিয়েই, রাজীব, আবার লঞ্চ করে চুঁচুড়া এসে, পড়িমড়ি করে সাইকেল চালিয়েছে। বাড়িতে এসে সাইকেল রেখেই গোরাদের বাড়ি। দাদু তো কেবল, ওদের নয়, পাড়ার সবার দাদু; দাদুর জায়গাতেই, পাড়ার ছেলেদের 'জাগৃতি' ক্লাব; দাদুই তো ক্লাবের নামকরন করেছেন। দাদুর ইচ্ছামত, পাড়ার গঙ্গার ঘাটেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হবে। একটাই মুশকিল, ঐখানে কাঠের ব্যবস্থা নেই। গোরা জানালো, 'দাদু, বেশ কিছুদিন আগে, বাগানের একটা বাবলা গাছ কাটিয়ে গোয়ালঘরে রেখেছেন; সেই কাঠের আগুনের শিখায় দাদুর স্বর্গারোহন হবে। পাড়ার ছেলেরা, দাদুর বাঁশ বাগান থেকে বাঁশ কেটে 'খাটুলি' তৈরি করে সদর দরজার সামনে রেখেছে; 'কাতার' দড়ি দিয়ে বেশ শক্ত, পাকাপোক্ত করে তা বাঁধা হয়েছে। রাজীব, আসার পর, এবার সবাই মিলে দোতলা থেকে দাদুর নশ্বর দেহ নামানো শুরু। দাদু, শেষ জীবনেও ছিলেন নীরোগ; ছিয়াছি বছরেও যেন রং ফেটে পড়ছে, যেন ইচ্ছা করেই দেহ ত্যাগ করেছেন। সিঁড়ি দিয়ে ছ'ফুট চেহারার লাশ, তলায় নামানো খুবই কষ্ট সাধ্য ব্যাপার; সিঁড়ির পরিসর স্বল্প, আবার রয়েছে চাপ-দরজা, দেওয়ালের আংটায় আটকানো, ফলে দুটো বাঁশের উপরে লেপ জড়িয়ে মৃতদেহ গড়গড়িয়ে নামানো হল চাতালে,আবার ওখান থেকে ঐ ভাবেই একতলার ঘেরা বারান্দায়, তারপর কোনোক্রমে বারান্দার দরজা থেকে বার করে বাড়ির উঠানে। এবার, পাড়ার কয়েকজন বামুনের পো, এসে ফতোয়া দিল, "দেখো, গোঁশাইদার মৃতদেহে যেন শূদ্রের ছোঁয়া না লাগে; "শোনা মাত্রই, রাজীবরা উষ্মা প্রকাশ করে বলে উঠলো," কে হে,বামুন পুঙ্গব! এতক্ষণ, কোথায় ছিলে?" বামুনের দল বলে উঠলো, "যত সব ডেঁপোর দল।"

মেয়েরা, দাদুর মুখে-কপালে চন্দনের টিপ পড়িয়ে সাজালো, সকলের চোখ ছলছল করছে; গঙ্গাদাদা, উপস্থিত সবাইকে মাটির ভাঁড়ে চা দিচ্ছে; সে উৎকলবাসী,দাদুর আবিষ্কার; দাদুর চাকুরি জীবনে, সেই কোনযুগে, হাওড়া স্টেশনে উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় গঙ্গাকে দেখে, মায়াবশতঃ নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন, বাড়ির সংলগ্ন শিবমন্দিরের পাশের ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা করেন, নিজের বাড়ির শিবঠাকুরের পুজোর ভার অর্পন করেন ও বাজারের বেশ কিছু দোকানের মালিককে বলে দোকানের গণেশ ঠাকুরের দৈনন্দিন পুজোর ব্যবস্থা করে, তার একটা হিল্লে করে দেন; এভাবেই, গঙ্গা কাকার একটা মাসিক আয়ের ব্যবস্থা হয়ে যায়; আর গঙ্গা কাকাও কখন যে এ সংসারের একজন হয়ে, রান্নার ভারটাও নিজের হাতে তুলে নেন। গঙ্গাকাকার বিয়ের ব্যবস্থাও করেছেন, যদিও রাজীবেরা কখনো গঙ্গাকাকিমাকে, এ বাড়িতে আসতে দেখেনি; দাদু নাকি, সোনার হার দিয়ে, গঙ্গা-কাকিমার মুখ দেখেছেন। আজ, সেই কাকামনি চিরকালের মত সবাইকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তাই গঙ্গাকাকার মুখও শোকাচ্ছন্ন।

পাড়ার বন্ধু রমেনের দাদা,বয়স্ক মানুষ, ছেলেদের সঙ্গেই আছেন। গোঁশাই দাদু,ওনার পিতা ন্যায়তীর্থ ভবশংঙ্কর ভট্টাচার্য মশাই'র স্নেহভাজন ছিলেন; ন্যায়তীর্থ মশাইও শতবর্ষের দিকে এগিয়ে চলেছেন, তবু ভাতৃপ্রতিমকে শেষ বিদায় জানাবার জন্য বাড়ির সামনে টুলে বসে আছেন। রমেনের দাদা, বাবার কাছ থেকে, শ্মশান ঘাটের ক্রিয়াকলাপ সব লিখে নিয়েছেন, কারন, পাড়ার ঘাটে, মিউনিসিপ্যালিটির মরুই-পোড়া বামুনের দেখা মিলবে না। নিজেরা, ন্যায়তীর্থের ছেলে হয়েও কেউই সংস্কৃতের প্রতি আকর্ষিত হয়নি, আর ন্যায়তীর্থ মশাইও ছেলেদের জোর করেননি, ওরা কেউই পুজো-আচ্ছার দিকে মনোযোগ দেয়নি। রমেনের দাদা, রবার-কারখানায়, রাজীবের বাবার সাথেই একসঙ্গে কাজে যাতায়াত করেন, গল্প করতে করতে আসা যাওয়ার, পথশ্রমটা কম বলে মনে হয়। একেবারে ঘড়ির কাঁটার মত নিখুঁত সময়ে, কারখানা যাওয়ার পথে ডাক দেন"হাজরা মশাই---"। তাই, রাজীবেরা, ওনার নাম দিয়েছে "বাবার ঘড়ি।"

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register