Sat 01 November 2025
Cluster Coding Blog

T3 || স্বাধীনতার খোঁজে || 26য় পায়েল চট্টোপাধ্যায়

maro news
T3 || স্বাধীনতার খোঁজে || 26য় পায়েল চট্টোপাধ্যায়

স্বপ্নে বোনা মৃত্যু-দূত

১৯০৭ সালের ২৬শে আগস্ট। বর্তমান লালবাজার অঞ্চলের এক অংশে তখন চিফ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত ছিল। আদালত চত্বরে সেদিন 'চিৎকার' 'কোলাহলে' রূপান্তরিত। 'অনুশীলন সমিতি', 'যুগান্তর'-এর মত গুপ্ত সংগঠনগুলোতে চলছিল পরিকল্পনা। লড়াইয়ের। সংগ্রাম-চেতনা। নিজেদের বিলিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি। দলে দলে যোগদান করেছিল কিশোর-কিশোরী। ভাষা, বয়সের ঊর্ধ্বে। জীবনকে ছাপিয়ে মৃত্যুর আলিঙ্গন।
ম্যাজিস্ট্রেটের আসনে সে সময় ডগলাস হলিনশেড কিংসফোর্ড। মেধাবী। দক্ষ নির্মমতায়। অত্যাচারী। 'বন্দেমাতরম' পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা চলছিল। শাসকের শোষণ-গাথা। আদালত চত্বরে ভিড় যুবকদের। অকুতোভয় তাঁরা। মামলার শুনানির দিন লোকসমাগম থাকতো চোখে পড়ার মতো। হাজার হাজার মানুষের ভিড় সামলাতে নাজেহাল শাসক পুলিশ।
২৬শে আগস্ট এমনই এক শুনানির দিন। জমায়েত ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। বারুদের গন্ধ লেগে রয়েছে যেন সংগ্রামীদের চোখে-মুখে। ভয়হীন সকলে। সমস্বরে ধ্বনিত হচ্ছে 'বন্দেমাতরম'। অত্যাচারিতরা দৃপ্ত কন্ঠে এগিয়ে আসছেন আদালত প্রাঙ্গণে। এলোপাথাড়ি লাঠি চালাতে শুরু করলেন সেখানে ডিউটিতে থাকা পুলিশ অফিসাররা। মনুষ্যত্বের নামে প্রহসন। লক্ষ্য আদালত চত্বর জনমানব শূন্য করে দেওয়া। লাঠির আঘাতে অনেকেই সরে গেল সেই প্রাঙ্গন থেকে। শুধু এক কিশোর ছাড়া।
সেদিনের পুলিশ ইন্সপেক্টরদের নেতৃত্বে ছিলেন অফিসার ই.বি.হুয়ে। হঠাৎ করেই সেই কিশোর তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন। বয়স চোদ্দ-পনের বছর। সাধারণ চেহারা। ইন্সপেক্টর-এর লাঠির বিরুদ্ধে পাল্টা জবাব দিলেন তিনি। পুলিশ অফিসারকে কিল, ঘুষি মারতেও বিন্দুমাত্র ভয় পেলেননা। বাকি পুলিশ ইন্সপেক্টররা তখন ছিনে-জোঁকের মত চেপে ধরল সেই কিশোরকে। অসম লড়াই। ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাস পর্যন্ত পৌঁছলো আষ্টেপৃষ্ঠে হাত-পা বাঁধা সেই কিশোর।
তাঁকে দেখে অট্টহাস্য করলেন ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড। 'মেয়ারলি মাইনর'। তবে শাস্তি মকুব নয়। 'হি হ্যাজ টু পে'। মূল্য নির্ধারণ। শাসককে আঘাত করার মূল্য নির্ধারিত হয়েছিল বেত্রাঘাত। তাও সর্বসমক্ষে। পনেরবার বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দিলেন ম্যাজিস্ট্রেট।
আবার আদালত চত্বরে নিয়ে যাওয়া হল সেই কিশোরকে। বেতের সপসপ আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সঙ্গে ধ্বনিত হচ্ছে স্বাধীনতার মন্ত্র। 'বন্দেমাতরম'। যতবার বেত মারা হচ্ছে তাঁকে বেতের আঘাতে তিনি চিত্কার করছেন। একটাই শব্দ বের হচ্ছে। 'বন্দেমাতরম'। এমনই ভয়হীনতার নাম সুশীল সেন।
সেদিন পাশবিকতা চরম সীমায় পৌঁছেছিল। একজন কিশোর বিপ্লবীর প্রতি অত্যাচার স্তম্ভিত করেছিল সাধারণ জনতাকেও। চোখ নামিয়ে সকলেই সরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সেই কিশোর? চোখেমুখে ছিল না কোন কষ্টের চিহ্ন। নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত, পাথরসম সুশীল সেনের চোখ। জলের লেশমাত্র নেই। বছর পনেরোর কোমল শরীর আঘাতে অবিচলিত।
কিন্তু এই নৃশংস ঘটনা বাংলার বিপ্লবী সংগঠনগুলোকে প্রভাবিত করেছিল। কিংসফোর্ডের নাম দেওয়া হয়েছিল 'কসাই কাজি'। নরমপন্থী মনোভাবাপন্ন বিপ্লবীরাও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। চরমপন্থীরা শুরু করলেন চিন্তাভাবনা। শাস্তি দেওয়ার শপথ নিলেন তাঁরা। শুরু হলো ছক কষা।
বেত্রাঘাতের ঘটনার পর অনেক বিপ্লবী মনে করেছিলেন শরীরের সঙ্গে ক্ষতবিক্ষত হতে পারে কিশোর মন। তাই তাঁকে উৎসাহ প্রদান করার লক্ষ্যে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল কলেজ স্কোয়ার চত্বরে। অকুতোভয় কিশোর সেদিন মাথা পেতে গ্রহণ করেছিলেন সকলের আশীর্বাদ। এই ঘটনা নিয়ে কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদ রচনা করেছিলেন গান
''যায় যাবে জীবন চলে আমার বেত মেরে কি মা ভোলাবে? আমি কি মা'র সেই ছেলে!''
সুশীল সেনকে যুক্ত করা হলো আরো বিপ্লবী কার্যকলাপের সঙ্গে। কিংসফোর্ড হত্যার চিত্রনাট্য রচনা শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। এই চিত্রনাট্যে যোগ হলো এক নাম। সুশীল সেন। প্রথম ধাপ ছিল কিংসফোর্ডের তৎকালীন বাসস্থানের সরেজমিন তদন্ত। কলকাতায় কিংসফোর্ডের বাংলো বাড়ির ওপর লুকিয়ে নজর রাখা শুরু করলেন সুশীল। একাধিকবার এই অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোয় কাছাকাছি গোপনে অপেক্ষা করেছেন সুশীল সেন। কিংসফোর্ডের গতিবিধির সম্বন্ধেও যথেষ্ট খোঁজ খবর পৌঁছে দিয়েছিলেন কিংসফোর্ড হত্যার চিত্রনাট্যকারদের কাছে। তবে কিংসফোর্ডের কর্মক্ষেত্র বদল-এর কথা শোনা যাচ্ছিল। প্রশাসনিক মহলে তেমন জল্পনা চলছিল। কলকাতা থেকে খুব শীঘ্রই বদলি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল কিংসফোর্ডের।
বদলির আগেই শত্রু নিধনে তৎপর হয়ে উঠলেন বিপ্লবীরা। একদিকে তৈরি হচ্ছে চিত্রনাট্য। যথাসময়ে মুজাফফরপুরে বদলির নির্দেশ এল কিংসফোর্ডের। ইংরেজ সরকার খুশি এই ম্যাজিস্ট্রেটের কর্মদক্ষতায়। অত্যাচারের সুচারু নিদর্শনে ব্রিটিশ সরকার প্রসন্ন। দ্রুত নতুন দায়িত্বভার গ্রহণ করার জন্য কোন মতে জিনিসপত্র গুছিয়ে ভিন্ন কর্মস্থলের দিকে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট।
এদিকে বিপ্লবীদের 'বিস্ফোরক' চিত্রনাট্যও প্রস্তুত। 'ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসেস' বা আই.ই.ডি। বর্তমানে প্রযুক্তির স্রোতে আই.ই.ডি অজানা, অচেনা নাম নয়। কিন্তু একশো বছর আগে এই বস্তু ব্যবহার করা ছিল নিতান্তই দুঃসাধ্য। কিন্তু শোষক নিধনের জন্য বিপ্লবীরা নিয়েছিলেন ঝুঁকি।
প্রথমবার সংগ্রামের ইতিহাসে এই বিস্ফোরক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। শুরু হলো মৃত্যু-দূত তৈরীর। ব্রিটিশ-শৃংখল মুক্ত স্বপ্নে গড়া মৃত্যু-দূত। বই-বোমা।
কিংসফোর্ডের বই-প্রীতি সকলেরই জানা। বিদায়ী ম্যাজিস্ট্রেটকে উপহার হিসেবে দেওয়া হবে এই মৃত্যুর পরোয়ানা। এমনই সিদ্ধান্ত হলো। বইয়ের মধ্যে বিস্ফোরক ভরে তা পৌঁছে দেয়া হবে কিংসফোর্ডের বাংলোয়। বই-বোমার নকশা রূপায়নের দায়িত্ব দেয়া হলো বিপ্লবী হেমচন্দ্র দাসের ওপর। নানা ধরনের বোমা তৈরীর কৌশল হেমচন্দ্র শিখে এসেছিলেন ফ্রান্স থেকে। সঙ্গে ছিল ম্যানুয়াল।
এবার তার প্রয়োগের পালা। কিন্তু কোন বইয়ে থাকবে মৃত্যুদূত? যে বই উৎসাহের উদ্রেক ঘটাতে পারবে কিংসফোর্ডের মনে! বাছা হলো আইন-সংক্রান্ত বই। হার্বাট ব্রুমের লেখা ''কমেন্ট্রিস অন দ্যা কমন ল"।
বই এর পাতার সংখ্যা ১০৭৫। হেমচন্দ্র প্রথম আশি পাতা আর শেষের চারশো পাতা ব্যবহার করলেন না। প্রায় ছ'শো পাতা বাকি তখনো। প্রত্যেক পাতাকে দক্ষতার সঙ্গে কেটে একটি চৌকো বাক্স তৈরি করলেন। কৌটোয় ভরে দেওয়া হলো মৃত্যুর রসদ। বিস্ফোরক বোঝাই কৌটো বইয়ের ভিতরে রাখা হলো। শেষে বইয়ের পাতা জুড়ে দেওয়া হল স্প্রিং দিয়ে। হেমচন্দ্র স্প্রিং এর ব্যবহার করেছিলেন কৌশলে যাতে বই খুললেই স্প্রিং এর মাধ্যমে জেগে ওঠে বই-বোমায় থাকা রাসায়নিক।
শুরু হয় অপেক্ষার প্রহর গোনা। কোন প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই শুধু দেশের প্রতি আত্ম-বলিদান-এর ইচ্ছা আর বুদ্ধির জোরে কয়েকজন তরুণ সৃষ্টি করেছিলেন স্বপ্নে মোড়া মৃত্যুদূত। বই-বোমা। তাঁরা অপেক্ষায় ছিলেন বই খোলার। তারপরে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। তীব্র বিস্ফোরণ। নিষ্পত্তি হবে 'কসাই কাজি'র অধ্যায়। সব অত্যাচার, শোষণের মোক্ষম জবাব।
বিপ্লবী পরেশ মৌলিক কিংসফোর্ডের কলকাতার বাংলো পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন এই বই-বোমা। সাহেব ততদিনে বদলির আদেশ পেয়েছেন। তাঁর বিদায় উপলক্ষ্যে অনেক উপহার এসে জড়ো হয়েছে বাংলোয়। সেই উপহারের ছদ্মবেশে যে এমন মৃত্যুর পরোয়ানা এসেছে ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না কিংসফোর্ড। বই-বোমা ট্রাক বন্দি হয়ে পাড়ি দিল মুজফফরপুর। সেখানে বাংলোর পাশেই অন্যান্য উপহার এর সঙ্গে স্থান হলো তার। পরে সময়-সুযোগ করে উপহার খুলে দেখা যাবে, এমনটাই সিদ্ধান্ত ছিল কিংসফোর্ডের। মৃত্যুদূতের সঙ্গে আয়ু বাড়লো সাহেবেরও।
এদিকে অধৈর্য হয়ে পড়ছেন বিপ্লবীরা। স্থির হল মুজাফফরপুর গিয়েই হত্যা করা হবে কিংসফোর্ডকে। প্রফুল্ল চাকী ও সুশীল সেন পেলেন দায়িত্ব। কিন্তু সুশীলের সঙ্গ দিল না তাঁর ভাগ্য। মৃত্যুশয্যায় বাবা। বিপ্লবী বারীন ঘোষ-এর নির্দেশে সুশীল সেন গেলেন বাবাকে দেখতে। মাতৃসম দেশ এবং জন্মদাতা পিতার মধ্যে সুশীল সেন বেছেছিলেন দেশকেই। কিন্তু বাদ সাধেন বারীন ঘোষ। জোর করে বাবার কাছে পাঠিয়েছিলেন ছেলেকে।
পরে কিংসফোর্ডকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর উপর। ব্যর্থ হন তাঁরাও। কিন্তু এই হত্যার ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত হয়েছিল সুশীল সেন-এর বুদ্ধিতেই। 'আলিপুর বোমা মামলা' চলাকালীন তদন্তের স্বার্থে পুলিশ অভিযান চালিয়েছিল কিংসফোর্ডের বাংলোয়। সেখানেই পাওয়া যায় এই বই-বোমা। ষড়যন্ত্রের ব্যর্থতা, দেশ-প্রেমের স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলা মৃত্যু-দূতে মাখানো ছিল কিছু তরুণের দেশ স্বাধীন করার স্বপ্নও। বর্তমানে এর স্থান কলকাতা পুলিশ মিউজিয়াম।
ইতিহাস, অতীত, স্মৃতি বড় বিষম বস্তু। প্রাণহীন, জড়পদার্থেও ধরে রাখে স্মৃতি। জমিয়ে রাখে কত অনুরাগ। সেদিনের সেই বই-বোমা নির্মাণকারীদের অনেকের নামই কালের গহীনে তলিয়েছে। কিন্তু স্বাধীন দেশের আকাশে-বাতাসে কান পাতলে আজও তাঁদের কীর্তির প্রতিধ্বনি শোনা যেতে পারে।

তথ্যসূত্র: অচেনা লালবাজার- সুপ্রতিম সরকার

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register