Tue 04 November 2025
Cluster Coding Blog

T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || 26য় অর্ঘ্য রায় চৌধুরী

maro news
T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || 26য় অর্ঘ্য রায় চৌধুরী

রাত বারোটার গাড়ি

কিছুই বলা যায় না, বলা উচিতও না, ক'দিন ধরেই রোজ রাত বারোটায় বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছে। সকাল হলে আর চোখে পড়ছে না। রাত বারোটাতেই, আগেও না, পরেও না। দোলগোবিন্দ বাবুর এমনিতেই রাতে ঘুম টুম বিশেষ আসে না, তার ওপর বাড়ির সামনে এরকম একটা উৎপাত, যদিও ক্ষতি কিছু হয়নি, কিন্তু হতে কতক্ষণ? দিনকাল সুবিধের না। কখন কী হয়ে যায় বলা মুশকিল। তিন নম্বর রামকানাই লেনের সামনেই ওনার দোতলা বাড়ি, একাই থাকেন। ছেলে মেয়েরা বিদেশে, স্ত্রী গত হয়েছেন। পাড়াতেও খুব একটা মেশেন না, শুধু হরেকৃষ্ণ মিত্তির মাঝেমাঝে খোঁজ নিতে আসেন। একমাত্র ওনার সঙ্গেই যা একটু কথাবার্তা হয়। বাকি লোকগুলো সব ছোটোলোক, মিশতে ইচ্ছা করে না। আজ রাতেও গাড়িটা এসেছে। কালো রঙের একটা অ্যাম্বাস্যাডার, যদিও এখন আর অ্যাম্বাস্যাডার দেখাই যায় না, তবুও যে বা যারা আসছে ওতে করেই তারা আসছে। আর সারারাত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ভোরের আগেই হাওয়া। ভেতরে কে আছে দেখার উপায় নেই, কালো কাচ, তোলাই থাকে। দোলগোবিন্দ সমাদ্দার একবার ভেবেছিলেন পাড়ার ছেলেদের খবর দেবেন। তারপর ভাবলেন, থাক, শেষে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোবে। কী না কী করছে গাড়িটা তার ঠিক নেই। হয়ত দেখা যাবে এলাকার কাউন্সিলার তপন তরফদারেরই এতে কোনো হাত আছে। এসব সাত পাঁচ ভেবেই চুপ করে থেকেছেন। কিন্তু তাঁর বাড়ির সামনেই বা কেন? এই ব্যাপারটা তাঁকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। কারো সঙ্গে যে আলোচনা করবেন সেই ভরসাও ঠিক পাচ্ছেন না। তবুও কিন্তু কিন্তু করে হরেকৃষ্ণ মিত্তিরকে ব্যাপারটা বলেই ফেললেন। হরেকৃষ্ণ সব শুনে কিছুক্ষণ গোঁজ হয়ে থেকে বললেন "ছাড়ো তো, তোমার কী দরকার? রাতে খেয়ে দেয়ে ভালো করে ঘুমাও। আরে যদি সেরকম কিছুই করত তাহলে কি এতদিন সেটা চাপা থাকত? এইজন্যই বলেছিলাম একটু ধম্মকম্মে মন দাও, তা না, সমানে ছুকছুক আর টেনশন, আরে বাবা বয়েস হয়েছে। ইয়াং এজে এসব ফেস করা যেত, এখন কিছু করতে যাবে, পরদিন দেখা যাবে গাড়ির সঙ্গে তুমিও হাওয়া, একদম জানলা খুলবে না। গাড়িটা এলে চুপচাপ কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়বে।" কিন্তু কৌতুহল যায় না। আর একা মানুষের কৌতুহল একটু বেশিই। রিটায়ার্ড লোক, পেনশন পান, কাজকম্ম কিছুই নেই। শেষ পর্যন্ত কৌতুহলেরই জয় হলো। এক নিশুতি রাতে দোলগোবিন্দ সমাদ্দার মাঙ্কি ক্যাপে মুখ ঢেকে হাতে একটা মোটা লাঠি নিয়ে গাড়িটার জানলার কাচে টোকা দিলেন। সব চুপচাপ, কোনো সাড়াশব্দ নেই। আবার টোকা সঙ্গে আওয়াজ "অ্যায়, ভেতরে কে? এখানে রোজ রাতে কী দরকার অ্যাঁ?" আস্তে আস্তে জানলার কাচটা নেমে গেল। ভেতর থেকে তড়াক করে সিড়িঙ্গে চেহারার এক ছোকরা নেমে এসে বলল "এই ত্তো কাক্কা, এসে গেচেন। চলুন চলুন আর সময় নেই। আপনি নিজে থেকে আসবেন জানতাম, তাই আর ঘাঁটাইনি।" দোলগোবিন্দ মহা ফাঁপড়ে পড়লেন। ছোকরা বলে কী? চাপা গলায় বলে উঠলেন "যাবো মানে? যাবোটা কোথায়? অ্যাঁ? যত্তসব।" সেই ছোকরা তাতে একটুও দমে না গিয়ে একগাল হেসে বলল " আহা চলুনই না কাকু, একদম দিল জান ঠাণ্ডা করে দেব, নিন নিন উটুন, উটে পড়ুন।" বলে প্রায় একরকম জোর করেই দোলগোবিন্দ সমাদ্দারকে গাড়িতে তুলে গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়িটা কোথা দিয়ে যাচ্ছে বোঝা গেল না, তবে রাস্তাটা খুব মসৃন, ঝাঁকুনি নেই। দোলগোবিন্দর প্রথম প্রথম একটু ভয় করলেও, শেষে ভাবলেন আচ্ছা দেখাই যাক না, ছোকরার দৌড় কতদূর। অবশেষে ফাঁকা মাঠের মধ্যে একটা বাড়ি, তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। বাড়িটা লম্বা মতন। দরজাটা ঘন নীল। বাড়িটার থেকে একটু দূরে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে তাঁরা দুজন ওই দরজাটা খুলে ঢুকলেন। সামনেই একটা টেবিল চেয়ার পাতা। সেখানে টাক মাথা ফর্সা একটা লোক বসে খাতায় কী যেন লিখছে। লোকটার মাথায় কেন? ভুরুতেও একটুও চুল নেই, গোঁফ দাড়িও কিছু নেই। দোলগোবিন্দ বাবুকে দেখেই সে বলে উঠল "অ্যাই ত্তো এসে গেচেন। মুকুন্দ, শিগগিরই আলো ফোটার আগে দোলগোবিন্দ পঁচাত্তরকে ওখানে রেখে এস। আহা দেরি কোরো না দেরি কোরো না। এখনই বেরিয়ে পড়ো, মুরগি ডাকতে আর দেরী নেই।" দোলগোবিন্দ অবাক, ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢুকছে না। এমন সময় ভেতরের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন অবিকল আরেকটা দোলগোবিন্দ। এসে ওনার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললেন "আসি তাহলে?" টাক মাথা লোকটা বলে উঠল "আহা যাও যাও দেরি কোরো না।" মুকুন্দ দ্বিতীয় দোলগোবিন্দকে নিয়ে ঝট করে বেরিয়ে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। আমাদের দোলগোবিন্দ বাবু মহা খাপ্পা হয়ে হয়ে বলে উঠলেন "বলি ব্যাপারটা হচ্ছেটা কী অ্যাঁ? কী হচ্ছে এ'সব?" সেই টাক মাথা নরম গলায় তাঁকে বলল "আহা, চটচেন কেন? আপনার তো সময় শেষ। পঁচাত্তর বছর ওবধি আপনার কাজ চিলো, করেচেন। এবার আপনার জীবদ্দশার বাকি দিনগুলো আপনার জায়গায় থাকবেন ওই দোলগোবিন্দ, দোলগোবিন্দ পঁচাত্তর। এখন তো আপনার আরাম করার বয়স। চিন্তা নেই চিন্তা নেই কাকপক্কিটিও টের পাবে না।‌ দেকচেন না, একনও কাকপক্কিরা জেগে ওটেনি! সবার সঙ্গেই এটা হয়। পঁচাত্তরের পরে সবাইকেই একানে আসতে হয়, একান থেকে আরেকজন সেই একই লোক তার জায়গায় গিয়ে বাকি বয়সটার কাজগুলো করে। সবাই সবাই, সবার সাথেই এটা হয়, কেউ বাদ নেই। আপনার বাবা কাকাদের সাথেও হয়েচিল, কেউ জানে না তো, তাই টের পায় না। ওই দেকুন না, আপনাদের পাড়ার ডাক্তার বটব্যাল, তিনিও তো আছেন।" বলে ডেকে উঠল " ওওও ডাক্তারবাবু একবার ইদিকে আসবেন না কি?" দোলগোবিন্দ সমাদ্দারের বিস্ফারিত চোখের সামনে দিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন পাড়ার পুরনো ডাক্তার সনাতন বটব্যাল। দোলগোবিন্দ বাবুকে দেখে বলে উঠলেন "আরে দোলগোবিন্দ! আজকেই এলে না কি হে?"
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register