Tue 04 November 2025
Cluster Coding Blog

T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || 26য় আরণ‍্যক বসু

maro news
T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || 26য় আরণ‍্যক বসু

আঁচলের চিঠি

খুব সাবধানে নেমে আয়,হাত ধর,আমি রয়েছি তো ; বন্ধু-শত্রু বল,আষাঢ়-শ্রাবণ বল , তোরই তো আমি। দুপুর সন্ধে বল , সফলতা ব‍্যর্থতায় এই যে আঁচল -- এরই নাম তো শ‍্যামলিমা,কখনও পুরোনো হয় ? অমাবস্যা পূর্ণিমায় তোরই ভিতরে ঘর বাঁধি। সেই কবে সরস্বতী নদী হয়ে হারাবার সুখ ,তীব্র সুখ.... এখনতো সুখেরই অসুখে হা-রিক্ত... ভেসে গেলো চাঁদ। এত যে ক্রন্দন , হাহাকার , রুদালির লুটোপুটি... এসব পেরিয়ে তোর কাছে যাই ; ও মরণ , তুঁহু মম শ‍্যাম... নারীর ধানের গন্ধে, ও পুরুষ ,লুটোবি না ? অঝোর বর্ষণ ? তুই এলে সূর্য...সূর্যোদয় , এ বুকের রাত-সরণীতে... আয় , নেমে আয় , খুব সাবধানে ... এই তো রয়েছি আমি। শ‍্যামলিমা তোকে ছেড়ে যেতে পারে ? বৃষ্টি বৃষ্টি মাস ? সেই কবে বলেছিলি, অকপটে-- নারী তুমি সম্পূর্ণ আকাশ !

আরব‍্য রজনীতে !

( মনে করো আমি নেই ,বসন্ত এসে গেছে , কৃষ্ণচূড়ার বন‍্যায় ,চৈতালি ভেসে গেছে.. ---সুমন কল‍্যাণপুরের গান ) তোমার জন‍্যে নির্জন নীল ছাত প্রতিদিনের প্রতিটি সারারাত তোমার জন‍্যে চোখের বিন্দু জল বিনা কারণে এড়িয়ে যাবার ছল । ফাগুন যখন ভীষণ ভীষণ মাতে প্রতীক্ষাতে এবং অপেক্ষাতে তুমি সেখানেই পথের ঘূর্ণিধুলো অন্তর্লীন আঁখিপল্লব ছুঁলো ! ও কোকিলা,আমের শাখায় আয় , পঞ্চমসুর তোর কাছে তাই চায় আমিও তোর বনজোছনায় ডুবে লাজুক ভোরের সুয‍্যি হবো পুবে। একুশ পেরিয়ে ফাগুন এখন ধীর পলাশকুঁড়ি বিস্ময়ে থিরথির তোর চিবুকে আমার কাঁপা হাত প্রতিদিনের প্রতিটি সারারাত। স্তম্ভিত এই কলঙ্কময় চাঁদ তিন ভুবনে কেন যে পাতে ফাঁদ ? তোমার সঙ্গে শালবনে,শীত শীতে... সহস্র এক আরব‍্য রজনীতে !

জাম-রঙা কালিতে লেখা

( " লজ্জা জড়ানো ছন্দে কেঁপেছি, ধরা পড়ি ছিল ভয়..." চিরদিনের বাংলা গান ) শ্রাবণ , তোমার মনে আছে ! সুগন্ধা , তোমার মনে আছে ? সন্ধে থেকে একটানা বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে--শ্রাবণের গগনের গায়, বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়... পাড়ায় সেদিন গোড়ালি-ডোবা জল, পল্লীর শেষ মাতাল বাড়ি ফিরলো যখন, রাত বারোটা বাজতে দশ। জড়ানো ঠোঁটে কী যেন গান... মধুশালা মে তালা না পড় যায়ে... আর আমি ? সেই কবেকার দাদুমার্কা কালো ছাতায় , ভিজতে ভিজতে ভিজতে ভিজতে , তোমার জানলায় টোকা দিচ্ছি । মনে আছে , শ্রাবণ ? ওহ সুগন্ধা , প্লিজ জানলাটা একবার খোলো। বৃষ্টিতে, বর্ষণে , ধারাজলে , আমার হৃৎপিণ্ডের সব অক্ষর , জাম-রঙা কালিতে লেখা একটা চিঠি ভিজে যাচ্ছে যে! সুগন্ধা, প্লি ই ই জ ! ওই তো তোমার গুনগুন শুনছি বৃষ্টি ছাপিয়ে-- আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন,ঝরঝর ঝরঝর ঝরেছে, তোমাকে আমার মনে পড়েছে.. ছাই মনে পড়েছে ! উনিশের আগলা পাগলা যৌবন, ভাঙা চোয়ালের ভীরু কবি, ইচ্ছে থাকলেও সৎসাহস নেই , সামনের দরজার অভিজাত কলিং বেলে আঙুল ছোঁয়ানোর। দিলওয়ালে দুলহানিয়ার অমরীশ পুরীর মতো গম্ভীর তোমার বাবার সামনে , নীচের ঠোঁট একটু কামড়ে দাঁড়ানোর। সুগন্ধা , প্লিজ জানলাটা একটু খোলো। সব অক্ষর , আমার রজনীগন্ধা-হৃদয়ের সবটুকু ধুয়ে মুছে একাকার । সেদিন আমার কাকভেজা শরীর , আমার মাঝরাতের মুখ , ব‍্যর্থতার লজ্জায় আমারই বুকের ওপর ক্রমশ ভেঙে পড়ছিল। জাম-রঙা কালিতে তোমাকে লেখা আমার একমাত্র চিঠি শেষ পর্যন্ত... না , তোমার মনে থাকবার কথা নয়,সুগন্ধা। কিন্তু , তোমার মনে আছে শ্রাবণ ? আজ এত বছর পরেও , সেই অক্ষর মুছে যাওয়া জাম-রঙের আভাটুকু কোটি কোটি বছরের ফসিলের মতো আমি বুকপকেটে বয়ে বেড়াচ্ছি। কিছুদিন পরে মেঘদিগন্তে শরৎ নামলে , ভোরে ঝিলের জলে শালুক পদ্ম তুলবে একরাশ খোলা চুলের কোনো বনদেবী ; তার অবাক চোখের সামনে , কাগজের নৌকো করে ভাসিয়ে দেবো আমার চিঠি। আজও চেনা অচেনা সেই বৃষ্টিবিন্দুরা , আবার প্রথম শ্রাবণ হয়ে লুটোপুটি খাচ্ছে তোমাদের পরিত্যক্ত বাড়িটার সঙ্গোপনেরও অতিগোপনে ! পুরোনো দেয়ালে বর্ষার টাটকা ও বাসি জলছাপ , জীর্ণ গ্র‍্যান্ডফাদার ক্লকে রাত থেমে আছে বারোটা দশে। স্খলিত মাতাল আজও বাড়ি ফেরে ওলটপালট গলার গানে-- মুঝে দুনিয়াওয়ালো শরাবি না সামঝো... তোমার মনে নেই সুগন্ধা। থাকলে , তোমার চকলেট কালারের হারমোনিয়ামে , সন্ধ্যাকণ্ঠে আজও অমলিন রাগ-জয়জয়ন্তী বেজে উঠতো-- কেন ডাকো বারেবারে ,আমারে , রিমঝিমঝিম বরষাতে... শ্রাবণ, শ্রাবণ , তুমি যেন ভুলে যেও না , জামরঙা কালিতে লেখা সেই একপাতা-চিঠির কথা !

আমি হবো পরিপূর্ণ কবি

কাঁটাতারের আগল খুলে যেদিন লাজুক হাওয়া ডাকবে-- রূপসী বাংলা তোমাকে স্বাগতম জানাচ্ছে কবি , এসো আমার হৃদয়ে। সে প্রথম বৃষ্টিপাত বা শেষ বর্ষণ হোক শিশিরপতনের নিঃশব্দ প্রহর হোক কুসুমের মাস বা শেষ পাতাঝরা দিন হোক... তুমি এসে দাঁড়ালেই , তোমার মেহেন্দি আঁকা হাতের শিহরণ স্পর্শ করে বলবো -- আমার পূর্বপুরুষদের হাসি-কান্না ভেজা মৃত্তিকার সুগন্ধ তুমি । তোমাকে দিলাম আমার স্বপ্ন-বাস্তব মেশা আঁখিপল্লব আর দেশের বাড়ির শিউলি উঠোন। তুমি আমাকে অনায়াসে দেবে--- কপোতাক্ষ , ভৈরব , চিত্রা , ভবদহ বিল , রাজগঞ্জ বাওড়ের ছলাৎ-ছল জল । তুমি দেবে গদখালির ফুলবাজারের সেরা গোলাপ ; হয়তো মণিহার সিনেমা হলে দুজন মিলে মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখবো, মুখর-অতীতের কোনো সাদা কালো ছায়াছবি... সে ছবির নাম হতে পারে -- নতুন ফুলের গন্ধ অথবা জীবন থেকে নেওয়া। তোমাকে দিলাম বাবা,কাকা ,জ‍্যাঠার পায়ে নাচানো ফুটবল জাদু। তোমাকে দিলাম মেজো পিসিমার পোলভল্ট আর একশো মিটারের দৌড়। তোমাকে দিলাম -- গোবরডাঙা, চাঁদপাড়া, বনগাঁ , বেনাপোল হয়ে শিশু গাছের ছায়া ঢাকা যশোর রোডের আশ্চর্য নস্টালজিয়া। তোমাকে দিলাম আমার বাংলার শাল-মহুয়ার গন্ধ , আর মাখা সন্দেশের ধপধপে সাদা হাসি। তোমাকে দিলাম বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্যের কোলে ইছামতীর জলে নামা চরাচর ফুটফুটে জোছনা। তুমি আমাকে সাগরদাঁড়ির অমিত্রাক্ষর ছন্দ দিলে, আমি হবো পরিপূর্ণ কবি। আমার পাসপোর্টে যে না লেখা কবিতা অদৃশ‍্যই থেকে গেল, তার নাম --- বাংলা আমার বাংলা ভাষা। ওই চেয়ে দেখো, আমাদের বসু বাড়ির শিউলি উঠোনে আমার মা বেতের মোড়ায় বসে গান ধরেছে-- আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা , আমি যে পথ চিনি না... বনজোছনা , তোমার মেহেন্দি হাতের পাতায় যেটুকু মাটির মায়া লেগে , যেটুকু যশোরের স্মৃতি লেগে ; ওইটুকুই দাও আমাকে, আমার কাঁপা হাতে। ভালোবাসার সেই নিভৃত চিরকুট নিয়েই বাড়ি ফিরে যাবো। পিছন ফিরে না তাকালেও-- জানি, আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকবে কাঁটাতারের বেড়া।

তুমির মধ‍্যে তুই !

শিমুল ডালের আড়ালে তুই চাঁদ হারিয়েছিলি ? আবার এলি ফিরে ? তুই যে আমার তুমির মধ‍্যে তুই রূপ ফোটালি ফাগুন-কলজে ছিঁড়ে ! জানিস ? নাকি জানবার নেই ইচ্ছে ? নির্মোহ নীলদিগন্ত কি তুচ্ছ ,? আঁচল জানে বুকের ওঠাপড়ায় অবাক তাকায় শ্বেতকরবীর গুচ্ছ ! বনজোছনা মোমের মতো গলছে ফাগুন এখন আকাশমণি গাছে মাথার ওপর ঈশ্বর না থাকুক নীলাকাশ আর মহাকাশ তো আছে... দুনিয়া-উজাড় রূপ না দেখাস যদি আগুন কেন লাগালি মনে-বনে ? মরে গেলাম ,ভীষণ নিঃস্ব হলাম ; পলাশ রে, তোর হৃদয়- আমন্ত্রণে ! সারা পৃথিবীর সাড়ে তিন ভাগ তামস তারই মধ‍্যে বাঁচবার বিন‍্যাসে তিন পয়সার মধ‍্যবিত্ত যাপন... কোত্থেকে যে ফুলের গন্ধ আসে ! ভীরু তাকালেই তোর তোর শ‍্যামলিমায় মুখ লুকোবে উদাসীন নিষ্ঠুর ঝরাপাতা যেই ঝড়কে ডাকবে-- আয় ! লতা-সন্ধ্যার আকুল চেনা সুর... মহুয়া ঝরা ঘাস বিছানায় শুই তুই যে আমার তুমির মধ‍্যে তুই !
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register