Wed 05 November 2025
Cluster Coding Blog

T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || 26য় মিঠুন মুখার্জী

maro news
T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || 26য় মিঠুন মুখার্জী

দশ হাতে দুর্গা!!

আজ সঙ্গীতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অসাধারণ রূপ-লাবণ্য ভালো করে প্রত্যক্ষ করলো। তার মনে মুহূর্তের মধ্যে এমন সব চিন্তার উদয় হল যা সে আগে কোনদিন ভাবেনি। ঈশ্বরের দেওয়া এই সুন্দর জীবন, এই রূপ লাবণ্য মুহূর্তের মধ্যে একমুঠো ছাইতে পরিণত হতে পারে --- যদি শরীরে শ্বাস না থাকে। এ জগতের কেউই জানে না কার কখন সেটি চলে যাবে। এত রূপ ও অর্থের অহংকার, হিংসা, উচ্চ- নিচ দৃষ্টিভঙ্গি মুহূর্তে বিলীন হয়ে যাবে। এমন সময় স্বামী রনজিৎ বাথরুম থেকে তাকে একটা টাওয়াল দেওয়ার জন্য বলল। প্রথমটায় এমন ভাবের জগতে ছিল সঙ্গীতা যে, স্বামীর ডাক সে শুনতে পাইনি। পরক্ষণেই বুঝতে পেরে খাট থেকে টাওয়ালটা নিয়ে রনজিৎকে দিতে যায়। এমন সময় পাশের ঘরের থেকে শ্বশুর চা দিয়ে যাওয়ার জন্য সঙ্গীতাকে ডাক দেয় ---"বৌমা আমার চা-টা দিয়ে যাও।" সঙ্গীতা দৌড়ে গিয়ে টাওয়ালটা দিয়ে শ্বশুরের জন্য চা বানাতে যায়। এমন সময় শাশুড়ি অনামিকা দেবী পূজার ঘর মুছে দেওয়ার জন্য বৌমাকে ডাকেন--- "সঙ্গীতা এখনো আমার পুজোর ঘরটা মোছা হলো না!" সংগীতা জানায়---"এখনই মুছে দিচ্ছি মা।" এরপর এক কাপ চা শশুরকে দিয়ে বালতিতে জল ও নেতা নিয়ে শাশুড়ির পুজোর ঘর মুছে দেয়। পুত্রবধূ তো নয়, যেন বাড়িতে কাজ করানোর জন্য অনেক খুঁজে খুঁজে একটা মেয়ে এনেছেন তারা। বৌমা যেন দশ হাতে দুর্গা। মুখ বুজে যতক্ষণ সবার ফাইফরমাশ খাটতে পারবে, ততক্ষণ শ্বশুর বাড়ির সকলের কাছে সে সোনা বউ। কিন্তু না পারলেই দক্ষযজ্ঞ বাঁধানোর জন্য সকলেই প্রস্তুত। এমনকি বৌমাদের শরীর খারাপ হওয়াও মানা। সঙ্গীতার শ্বশুর-শাশুড়ি বিয়ের আগে সঙ্গীতার বাবা-মার কাছে চাকরি করা ছেলেটির হয়ে অনেক বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলেছিলেন। আপনার মেয়ে রাজরানী হয়ে থাকবে, আমার তো মেয়ে নেই ও আমার মেয়ে হয়ে থাকবে। সঙ্গীতার বাবা-মা চাকরি করা ছেলে দেখে ও রনজিতের মা-বাবার অত সুন্দর সুন্দর কথা শুনে মেয়ের বিয়েতে মত দিয়েছিলেন। তারপর রনজিতের দুই ভাই বিদেশে থাকে। বাড়ির একা বউ হওয়ায় মেয়ের কোন কষ্ট হবে না ভেবেই বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের একমাস কাটতে না কাটতে তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, তারা কি ভুল করেছেন। চাকরি করা ছেলের চেয়ে যদি একজন ব্যবসায়ী ভালো ছেলের হাতে তারা মেয়েকে বিয়ে দিতেন তাহলে হয়তো বেশি ভালো হতো। আগে তাদের দেখা দরকার ছিল ছেলেটি ভাল কিনা। তাছাড়া শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ খবর নেওয়ার দরকার ছিল। মাত্র দুই সপ্তাহের দেখাশোনায় বিয়ে হয়েছিল সঙ্গীতা ও রনজিতের। কুড়ি বছরের সঙ্গীতার স্বামীর বয়স আটত্রিশ বছর। আঠারো বছরের বয়সের পার্থক্য। বর্তমানের মেয়েরা এত ডিফারেন্সে বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু সঙ্গীতার বাবা-মার চাকরি দেখে বয়সের তফাতটা চোখে পড়েনি। বাবা-মার বাধ্য সঙ্গীতার অনিচ্ছা থাকলেও কিছু বলতে পারেনি সে। এই যুগেও নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই নিরুপায়। সঙ্গীতার স্বামি রনজিৎ স্বাভাবিক থাকলে তাদের দুজনের মধ্যে কোন সমস্যাই হয় না। কিন্তু অফিস থেকে ফেরার সময় বেশিরভাগ দিনই মদ খেয়ে আসতো। বাড়ি ফিরে সামান্য সামান্য কারণ নিয়ে সঙ্গীতাকে মারধোর করতো। উচ্চশিক্ষিতা সঙ্গীতার দুচোখ দিয়ে শুধু জল ঝরতো আর তার নিজের কপালের চিন্তা করে ভগবানের উপর খুব রাগ হতো। তার মতো এমন মেয়ে দেখাই যায় না। সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেও সংসার করত সে। এখনকার দিনে নারীদের সহ্য শক্তি কম। তাই এত ডিভোর্স দেখা যায়। কিন্তু বাবা-মার চিন্তা করে সঙ্গীতা একবারের জন্যেও সে চিন্তা মাথায় আনত না। মাঝে মাঝে অশান্তি এতই চরমে পৌঁছাত যে আত্মহননের চিন্তা তার মাথায় এসেছিল। কিন্তু পরক্ষণেই বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে--- ফলে সে পারেনি। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার সুবাদে ছেলে-মেয়ে উভয়ের কর্তব্যই পালন করতে হতো তাকে। স্বামীর যন্ত্রণা ছাড়াও শ্বশুর শাশুড়ির অত্যাচারও তাকে কম সহ্য করতে হয় না। বাড়ির বউ সঙ্গীতা যেন বাড়ির পাশের নিম গাছটার মতো। গাছটি যেমন তার সবকিছু মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছে, সেরকম সেও শ্বশুর বাড়ির সবার সেবায় সদা ব্যস্ত। অথচ তার মূল্য ওই নিম গাছটার মতোই। প্রয়োজনে ডাল ভেঙ্গে নেওয়া, পাতা ছেঁটে দেওয়া আবার কখনো সমূলে উৎপাটন করে দেওয়ার মতো। কলেজ জীবনে সঙ্গীতা কাজল নামের একটি ছেলের প্রেমে পড়েছিল। তখন কাজল বি.এ তৃতীয় বর্ষে ও সঙ্গীতা বি.এ প্রথম বর্ষে পরে। কাজলকে নিয়ে সঙ্গীতা এক বুক স্বপ্ন দেখেছিল। কাজল লটারিতে পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার পেয়ে, সেই টাকায় একটি বইয়ের দোকান দিয়েছিল। সঙ্গীতার বি.এ পাস হয়ে যাওয়ার পর কাজল তার বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে সঙ্গীতার বাবার কাছে তাদের চার হাত এক করে দেবার প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলের সামান্য বইয়ের দোকান শুনে তারা রাজি হননি। সঙ্গীতা ও কাজল চাইলে পালিয়ে গিয়ে বাবা-মার অমতে বিয়ে করতে পারতো, কিন্তু তারা তা করেনি। স্বেচ্ছায় তারা মনের কষ্ট চেপে রেখে সম্পর্কের গলা টিপে দিয়েছিল। কাজল ও সঙ্গীতা দুজনেই খুব কেঁদেছিল। তবে সময়ের সাথে সাথে তারা সব ভুলেও যায়। আজ সঙ্গীতার বাবা-মা মাঝে মাঝেই অনুশোচনায় দগ্ধ হন। এখন তাদের মনে হয় কাজল-ই তাদের মেয়েকে প্রকৃত সুখী রাখতে পারত। টাকাপয়সা সবসময় সুখের সন্ধান দেয় না। তারা মেয়েকে সরকারি চাকরি করা ছেলে ছাড়া বিয়ে দেবেন না মনস্থির করেছিলেন। কাজেও তাই হয়েছিল। কিন্তু তারা যে কত বড় ভুল করেছেন তা আজ বুঝতে পেরেছেন। তবে এখন কিছু করার নেই। এদিকে কাজলের বইয়ের দোকান এতদিনে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। কলেজস্ট্রিটে আরো দুটি বইয়ের দোকান করেছে কাজল। 'কাজল পাবলিকেশন'- নামে একটি ছাপাখানা খুলেছে, যেখান থেকে বিভিন্ন ভালো ভালো লেখকের বই প্রকাশিত হয়। সব মিলিয়ে কুড়ি জনের উপরে কর্মচারী রেখেছে। তাদের কারও বেতন মাসে দশ হাজার, কারোবা কুড়ি। সারা মাসে কয়েক লক্ষ টাকা আয়- ব্যয় করে সে। নিজের দুটি গাড়ি কিনেছে। একটিতে সে ও অন্যটিতে বাবা-মা যাতায়াত করে। আজ কাজলের অর্থের কোন অভাব নেই। মা বাবার আশীর্বাদে অনেক বড় সে হয়েছে।কিন্তু একটা অভাব আজও কাজল অনুভব করে। সেটি হল সঙ্গীতাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে না পাওয়া। সঙ্গীতার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর মনে মনে সংকল্প করেছিল সে---জীবনে আর কাউকে জীবনসঙ্গিনী করবেনা। বাবা-মা অনেকবার বিয়ে করার কথা বলেছেন, কিন্তু কাজল রাজি হয়নি। সে তাদের বলেছে---বিয়ে নাই বা করলাম, বিয়েতে আর আমি বিশ্বাসী নই। বাকিটা জীবন আমি আমার ব্যবসা ও তোমাদের নিয়ে কাটিয়ে দিতে চাই।" তবে আজও কোনো এক নিভৃত মুহূর্তে দুজনেরই দুজনের কথা মনে পড়ে। সেই কলেজের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা আজও মানসপটে ভেসে ওঠে। শুধু যে স্বামীর সুখ থেকে সঙ্গীতা বঞ্চিত তা নয়, সন্তানসুখ থেকেও বঞ্চিত। আজ বিয়ে হয়েছে দশ বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু তাদের একটিও সন্তান হয়নি। ভাইরা দাদার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে ভেবে রনজিৎ মায়ের কথায় কোন সন্তান নেইনি। সঙ্গীতা অনেকবার তাকে একটা বাচ্চা নেওয়ার কথা বলেছে, কিন্তু রনজিৎ রাজি হয়নি। কারণ সঙ্গীতাকে কোনো দিন বলেনি। কিন্তু মূল কারণ সে জেনে যায়। সংগীতার মা অনেকবার তাকে সন্তান নেওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করলে, সে নানান কথায় তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু একদিন তার মার কাছে সব সত্য তুলে ধরে সঙ্গীতা। আবারো সঙ্গীতার মা তাদের ভুলটা বুঝতে পারেন। গত দু'বছর আগে দুর্গাপূজার সময় সঙ্গীতার দুই দেওর বাড়িতে এসেছিল। তারাও বৌদির প্রতি একটু হীন দৃষ্টিতে দেখে। সব সময় তাদের সমস্ত কাজ করার জন্য সঙ্গীতাকে বাধ্য করতো। করতে মন না চাইলেও রনজিতের ও শ্বশুর-শাশুড়ির চিন্তা করে করে দিত। কখনো স্নানের জল তোলা, কখনো চা করা, কখনো জামা প্যান্ট আয়রন করা, আবার কখনো জুতোজোড়া কালি করে দেওয়া। এককথায় অন্যের গতর এরা সস্তা দেখে। যে দুমাস তারা ছিল সঙ্গীতাকে একেবারে নাজেহাল করে দিয়েছিল। কথায় বলে স্বামী ভালো না হলে পত্নীর দুঃখের অন্ত নেই। স্বামী যখন বউকে দাসী ভাবে তখন অন্যেরা তো ভাববেই। এবারের দুর্গাপূজয় দুজন দেওরের আবার আসার কথা আছে---সঙ্গীতা এই চিন্তা করে টেনসনে পড়ে যায়। মদ খেয়ে একদিন রাতে রনজিৎ গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরার সময় গাড়ির নিয়ন্ত্রন হারিয়ে একটি লাইটপোস্টের সঙ্গে মেরে দেয়। কয়েকজন মানুষ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। তিনদিন পর রনজিৎ মারা যায়। সঙ্গীতা কান্নায় ভেঙে পড়ে। কিন্তু তার শাশুড়ি তাকে "ডাইনি আমার ছেলেকে খেলি"--- বলে যাচ্ছেতাইভাবে গালিগালাজ করতে থাকে। তাতে সঙ্গীতা আরো বেশী কষ্ট পায়। রনজিতের কাজ মিটে গেলে সঙ্গীতার বাবা-মা শাশুড়ির গঞ্জনার হাত থেকে মেয়েকে চিরতরে রক্ষা করতে বাড়িতে নিয়ে যান। আর কখনো রনজিৎদের বাড়িতে যেতে দেননি।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register