- 14
 - 0
 
স্বাদকাহন - মোদক
বাঙালির ভাদ্র মাস পড়ে যাওয়া মানেই একে একে দেবদেবীর আগমনের পালা শুরু হয়। মা দূর্গা সন্তানসন্ততি সমেত বাপের বাড়ি এলেও তার সন্তানরা মর্তে একা একাই আসেন৷ আর সর্ব প্রথম পা দেন, সিদ্ধিদাতা গণেশ। মহারাষ্ট্রে থাকার ফলেই এই গণেশের মহাবন্দনা ও বৃহদাকার পুজো সম্পর্কে জানতে পেরেছি। তবে আমি যেহেতু খাবার দাবারের দিকে বেশি আগ্রহী তাই গণেশ পুজোর সময় আমার চোখ আর জিভ কোন কথা শোনে না। সোজা গণেশের প্রিয় খাবার মোদকের দিকে চলে যায়৷
গণেশ পুরানের গল্প শুনেছিলাম। একদিন দূর্গা তথা পার্বতী নিজের হাতে মোদক তৈরি করে সন্তানসন্ততিদের ডেকে পাঠালে। তারা উপস্থিত হলে সবার উদ্দেশ্যে বলেন, যে এই খাবার খাবে সে হবে সর্বজ্ঞানী, সর্বশ্রেষ্ঠ৷ গণেশ খেতে ভালোবাসে ফলে সব কিছুর আগেই তার জিভের রসনা তৃপ্তির কথা মাথায় এলো। আর মা বানিয়েছে তো কার্তিকই বা কেন বাদ যাবে৷ ফলে কার্তিক গণেশ দু'জনেই খেতে চাইল। এদিকে মাতা পার্বতী দুই ভাইকেই শর্ত দিলেন৷ বললেন, যে তিন লোক অর্থাৎ স্বর্গ মর্ত পাতাল প্রদক্ষিণ করে আগে ফিরে আসবে সেই পাবে এই অপূর্ব স্বাদের মোদক। কার্তিক এক মুহুর্ত দেরি না করে ময়ূরের পিঠে চেপে বেরিয়ে পড়লেন৷ এদিকে গণেশ ভাবছেন, পিতা মাতাই তো জগৎ। ফলে তাঁদের অর্থাৎ মহাদেব ও পার্বতীর চার পাশে ঘুরে বললেন, "পিতা মাতাই সমগ্র জগতের প্রতীক" খুব সহজেই গণেশ সারা জগৎ ভ্রমন করতে নিল। পার্বতী গণেশের এমন চমৎকার কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গণেশ কে দিলেন, জ্ঞান ও আনন্দের প্রতীক মোদক৷ আর সেই থেকেই গণেশের ভীষণ প্রিয় খাবারের মধ্যে অন্যতম হলো মোদক।
এতো গেল পুরানের গল্প কথা। তবে সত্যিই কি মনে এই প্রশ্ন জাগে না, কেনই বা মোদককে জ্ঞান ও আনন্দের প্রতীক বলা হয়। থালা ভর্তি যে আদি বা পুরনো আসল ভাপে সেদ্ধ করা মোদক গণেশের সামনে নিবেদিত হয় তা দেখতে একে বারে বন্ধ পদ্ম ফুলের মতো। পদ্মফুল হলো জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক জাগরণের প্রতীক৷ আর পুরানের গল্প অনুযায়ী গণেশ মোদক পেয়েছিল, বুদ্ধি ও জ্ঞানের পরিচয় দেখিয়ে। আবার আমরা ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করি যাতে আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি হয় ও আমরা সঠিক পথে জীবন নির্বাহ করতে পারি। অর্থাৎ ঈশ্বরের কৃপায় খুলে যাবে জ্ঞান চক্ষু তথা পদ্মের পাপড়ি৷ আবার দার্শনিক ভাবে যদি বিচার করি তাহলে দেখতে পাই, পদ্ম যেমন মাটি ও জলের মাঝেও নিজের সৌন্দর্য ধরে রাখে, তেমনি মোদক বাইরের সরল আচ্ছাদনের ভেতরে অন্তরের মাধুর্য লুকিয়ে রাখে। মানুষের জীবনও পদ্ম বা মোদকের মতো—
বাহ্যিক জটিলতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে প্রকৃত জ্ঞান ও আনন্দ। ওহ, যে কথাটা অবশ্যই বলে রাখার প্রয়োজন, সংস্কৃততে “मोधक (মোদক)” শব্দ এসেছে “মোদ” শব্দ থেকে। যার অর্থ হল, আনন্দ বা সুখ। অর্থাৎ মোদক মানে – আনন্দদায়ক খাদ্য।
তাহলে, মোদক বেশ অমৃত ধরণের খাবার বলেই মনে হচ্ছে, কি তাই তো? বর্তমানে বাজারে বা মিষ্টির দোকানে যে মোদক পাওয়া যায় তা বেশিরভাগই মাখা সন্দেশ দিয়ে তৈরি। আসল মোদক অনেকটাই আমাদের বাঙালীদের পুলিপিঠের মতো, যার পুর গুড় ও নারকেল দিয়ে তৈরি হয়। মোদকের গঠনটা একেবারে আলাদা৷ আসলে একই জিনিস নানান জায়গায় নানান ভাবেই বিখ্যাত৷ এই মোদককেই ভারতের নানান রাজ্যে নানান নামে ডাকে৷ যেমন তামিল ভাষায় মোথাগম বা কোঝুকাত্তাই, কন্নড় ভাষায় মোধাক বা কাদুবু এবং তেলেগু ভাষায় কুডুমু।
ভাগবত পুরাণ, গণেশ পুরাণ, পদ্মপুরাণ—এগুলোতে মোদকের উল্লেখ আছে। এমনকি, আয়ুর্বেদ সংহিতা (চরক সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতা)-তেও মোদকধর্মী মিষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায়, যা শরীরকে শক্তি, পুষ্টি ও মানসিক প্রশান্তি দেয় বলে ধরা হত। তাই বলা চলে মোদক আধুনিক ইতিহাসের অন্তর্গত নয়৷ বহুযুগ ধরেই প্রচলিত হয়ে আসছে এই অমৃত খাবার টি৷
শোনা যায়, জাপানে, মোদকের অনুরূপ একটি মিষ্টি কাঙ্গিদান, যা দেবতা কাঙ্গিতেনের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। এই দেবতাটি জাপানি ভাষায় গণেশের সমতুল্য। কাঙ্গিদান হল দই, মধু এবং লাল শিমের পেস্ট দিয়ে তৈরি এক ধরণের মিষ্টি। শুকিয়ে যাওয়া ময়দা দিয়ে তৈরি ময়দার মধ্যে মুড়িয়ে বানের মতো আকার দেওয়ার পর এগুলি ডুবিয়ে ভাজা হয়। যাকে বলে ডিপফ্রাই৷ ভাপে সেদ্ধ না করলে আমাদের দেশের মোদকও কিন্তু ভেজেই খাওয়া হয়৷
স্টিম মোদক আসলে একটি ডাম্পলিং৷ ভারতবর্ষের বাইরে বেরলেই দেখা যায় নানান দেশে নানান ধরণের ডাম্পলিং খাওয়ার প্রচলন আছে। ইতালীয় র্যাভিওলি থেকে শুরু করে পোলিশ পিরোশকি, চাইনিজ পট স্টিকার, ঘানার ফুফুটো নেপালি'মোমো থেকে শুরু করে ডাম্পলিংও একটি প্রাচীন খাবার। রোমান সাহিত্যে এর রেসিপি পাওয়া যায়, এবং চাইনিজ ডাম্পলিং অবশ্যই আরও প্রাচীন। তবে মোদক মহারাষ্ট্রেই উদ্ভাবন হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এতো পুরনো ইতিহাস, যে চাইলেই বদলে ফেলা যায়৷ কারণ মহারাষ্ট্রের মোদক যে বহু পুরনো তার প্রমান আমরা পুরানের বইগুলোতেই পেয়ে থাকি। তাই নানান খাবারের মতো বিদেশ থেকেই যে আগমন করেছে তেমনটা মনে হয়নি। আবার এও মনে হচ্ছে এখান থেকেও ওখানে যায়নি। যে যার নিজের খাবার অভ্যেস অনুপাতেই এই খাবারটির হরেক রূপ ও স্বাদ ৷ আসলে এইটিই বিদেশিদের ডাম্পলিং আর আমাদের ভাপা পুলি পিঠে কিংবা মোদক।
চীনাদের অবশ্য অন্য দাবী৷ কারণ বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে স্টাফড ডাম্পলিং আবিষ্কার করেছিলেন ঝাং ঝংজিং, একজন চীনা চিকিৎসাবিদ যিনি পূর্ব হান রাজবংশের অধিবাসী ছিলেন, যা চীনের দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী রাজবংশ ছিল এবং খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ থেকে ২২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। তবে এই ডাম্পলিং যেমনই হোক না কেন আমাদের ভারতীয়দের মোদক একেবারেই আলাদা৷ কারণ গুড় দিয়ে তৈরি মোদক হজমে সাহায্য করে, বিপাক বৃদ্ধি করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে। গুড়ে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং খনিজ পদার্থ রয়েছে যা শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করে লিভার, শ্বাস নালীর, কোলন এবং পাকস্থলী পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। গুড় স্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরল বাড়ায়, বর্ষা-সম্পর্কিত জীবাণুর সাথে লড়াই করে, সর্দি-কাশি এবং ফ্লু নিরাময় করে। অতয়েব মোদক যে কেন অমৃত সমান তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে৷
ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রসাদ বলেই হয়তো দুটো বেশি কথা বলা হয়ে গেছে। আর, মোদকের ইতিহাস শুধু রান্নার ইতিহাস নয়, বরং পুরাণ, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র ও লোকসংস্কৃতির সমন্বয়। এজন্যই আজও মোদককে শুধু মিষ্টি হিসেবে দেখা হয় না, বরং আনন্দ, জ্ঞান, পূর্ণতা ও ঈশ্বরভক্তির প্রতীক হিসেবেও মানা হয়।
0 Comments.