Wed 03 December 2025
Cluster Coding Blog

ধারাবাহিক || ভ্রমণ সিরিজ আফ্রিকার ডায়েরি - ১১ || সুব্রত সরকার

maro news
ধারাবাহিক || ভ্রমণ সিরিজ আফ্রিকার ডায়েরি - ১১ || সুব্রত সরকার

(নামাঙ্গা- নাইরোবি শহর - নাইরোবি ইউনিভার্সিটি - লেক নাকুরু ও লেক নাইভাসা) 


নামাঙ্গা সীমান্তে ইমিগ্রেশন ও সিকিউরিটি চেক খুব সহজেই হয়ে গেল। মাসাইমারা ঘুরে কেনিয়া থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম পাঁচদিন আগে, আজ আবার কেনিয়ায় ঢুকব। তাই ভেবেছিলাম হয়তো অনেক কড়াকড়ি চেকিং হবে। কিন্তু দেখলাম তেমন কিছুই হলো না। সহজেই সব কাজ মিটিয়ে পৌঁছে গেলাম মাসার গাড়ির কাছে।

মাসা সব সময়ই হাসিখুশি থাকে। হেসেই জানতে চাইল, "তানজানিয়া কেমন লাগল?"

আমরা একসঙ্গে তিন জনই বললাম, "দারুণ।"

মাসা বলল, "নো। নো। কেনিয়ার চেয়ে ভালো হতেই পারে না!.."

আমরা হেসে বললাম, "কেনিয়া সবার চেয়ে ভালো তোমাকে কে বলেছে?"

মাসা এবার বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, "আফ্রিকার মধ্যে সেরা দেশ হলো কেনিয়া।"

মাসা এমনই অবসেস্ড কেনিয়া নিয়ে। নিজের দেশকে এত ভালোবাসে এমন এক যুবককে দেখে সত্যিই ভালো লেগেছে আমাদের।

 মাসা এবার আমাদের মালপত্র ওর গাড়িতে গুছিয়ে নিয়ে বলল, "আমরা এখন একটা লংজার্নি করব। নামাঙ্গা টু নাইরোবি চার ঘন্টা লং ড্রাইভ। বাট একটা ব্যাড নিউজ আছে।"

"ব্যাড নিউজ!.. কি সেটা?" অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।

মাসা একটা ছোট্ট কাগজ এগিয়ে দিল। সেটা একটা লিফলেট। আমাদের হোটেল NAIROBI - Safari Club থেকে দিয়েছে। তাতে লেখা দেখলাম- Planned Demonstration, Dear Guest... We hope this notice finds you well....please be informed that a public demonstration is scheduled... আজ নাইরোবি শহরে সকাল থেকে সন্ধে বারো ঘন্টার এক বিক্ষোভ সমাবেশ রয়েছে। শহর উত্তপ্ত থাকবে। অশান্তি হতে পারে। তাই আগাম সতর্ক করে লেখা রয়েছে আমরা যেন সন্ধে সাতটার পর হোটেলে আসি!...

লিফলেটটা পড়ে বেশ চিন্তা বাড়ল। বেড়াতে এসে রাজনৈতিক ঝামেলার মধ্যে পড়লে বেড়ানোর বড় ক্ষতি হয়, দু'বছর আগে বাংলাদেশ ভ্রমণের মাঝখানে আমি চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম নড়াইল থেকে । কুষ্টিয়া, খুলনা ঘুরে নড়াইলের বিখ্যাত নৌকো বাইচ প্রতিযোগিতা দেখতে নড়াইলে আমি তখন ছিলাম। অশান্তির আগুন জ্বলতে শুরু করে সেসময়। প্রথমে মনে হয়েছিল সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বেড়িয়ে হাসিমুখে নিজের দেশে ফিরে যেতে পারব। কিন্তু না পারি নি! প্রাণ নিয়ে প্রায় পালিয়েই এসেছিলাম।...তাই কেনিয়ায় এসে নাইরোবির এই বিক্ষোভ সমাবেশ এর কথা শুনে মনে মনে সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করলাম।

মাসা বোধহয় বুঝতে পেরেছিল আমাদের চিন্তার কথা, তাই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, "ডোন্ট অরি। হাকুনা মাটাটা। আমরা ধীরে সুস্থে যাব। শহরে ঢুকব না সাতটার আগে। ওকে। তান্ডে- লেটস গো!.. এনজয়!.."

আমার হাতে লিফলেটটা রয়েছে, আমার চোখ তখনও লিফলেটে- road closures, especially around the CBD, Githurai, Rongai, Kisumu, Nakuru, Eldoret, Mombasa, Migori, Kisii and areas near University!.. ডুলুং- সোহমও দেখল লিফলেট টা। ওদের তো কাল সেমিনারে পেপার প্রেজেন্টেশন শুরু হবে। তাই দুজনেই চিন্তিত হয়ে পড়ল।

মাসার ঘোড়া ছুটতে শুরু করেছে। মাসার গল্পও চলছে। ও একদম চুপ করে গাড়ি ড্রাইভ করতে পারে না। হয় কথা বলবে, নয় গান শুনবে। আমাদের মধ্যে তানজানিয়া ভ্রমণের গল্প হলো অনেক। মাসা মন দিয়ে শুনল, কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই কেনিয়া শ্রেষ্ঠ এটা ও বলবেই!..

নামাঙ্গা থেকে নাইরোরি চলেছি। কত যে গ্রাম - শহর- জনপদ- কৃষিজমি- জলাশয়- নদী দেখতে দেখতে চললাম। পথের শোভা একটু একইরকম হলেও দেখতে ভালো লাগে। হাইওয়েটা চমৎকার। মাসা গল্প বলে যাচ্ছে। আমরা শুনছি। প্রশ্ন করছি। আবার উত্তরও শুনছি। অনেকটা পথ চলে এসে মাসা থামল একটা পেট্রোল পাম্পে। তেল নেবে। আমাদের বলল, "তোমরা ওয়াশরুম ইউজ করতে চাইলে করে নাও।"

নাইরোবি শহরের অনেক আগে একটা সুন্দর শপিং মল- Carrefour. ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে পাঁচটা বাজে। মাসা আমাদের বলল, "তোমাদের দু'ঘন্টা ফ্রি টাইম দিলাম। এই মলে ঘুরে বেড়াও। শহরের ডেমনস্ট্রেশন উঠলে তোমাদের ফোন করব। চলে এসো। নিয়ে যাব তখন হোটেলে।"

সরাসরি হোটেলে যেতে পারলেই ভালো হোত। শরীরও ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম দরকার। তার ওপর ডুলুংরা একটু সময় পেত সেমিনারের জন্য তৈরী হয়ে নেওয়ার।

শপিং মলে ঘুরে কিছুটা সময় কাটালাম। বিশাল মল। কিন্তু আজ অর্ধেক দোকানই বন্ধ!.. কারণ এই ডেমনস্ট্রেশন। তাই একটু ঘুরে ফিরে উইন্ডো শপিং করে একটা কফি শপে গিয়ে বসলাম। The Artcaffe দোকানটার নাম। কফি নিয়ে গল্প করতে করতে অনেকটা সময় কেটে গেল। ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজে। মাসা ফোন করল, "তোমরা এবার চলে এসো। নাও অল আর নর্মাল। আমরা হোটেলে যেতে পারব এখন।"

নাইরোবি শহরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখলাম, সারা শহর বিক্ষোভের জেরে লন্ডভন্ড। রাস্তা শুনশান। পুলিশের গাড়ি টহল দিচ্ছে। পাহারাও দিচ্ছে পুলিশের দল। মাসা খুব সাবধানে ইট, পাথর, ভাঙা কাঁচের বোতল, পোড়া টায়ার সব কিছুকে পাশ কাটিয়ে দেখে শুনে গাড়ি নিয়ে এসে হোটেলের লবিতে উঠল। রাজধানী শহরের এই চিত্র দেখে মনে মনে একটু শঙ্কিতই হলাম।

 "জাম্বাো জাম্বো। কারিবু" বলে হোটেলের রিসেপশন থেকে একজন এগিয়ে এলেন। আমরা থ্যাঙ্ক য়ু বলে হেসে ধীরে ধীরে হোটেলে প্রবেশ করলাম। হোটেলে সিকিউরিটি চেকিং হলো আমাদের। এর আগে এভাবে কোনও হোটেলে সিকিউরিটি চেকিং হয় নি।


নাইরোবি সাফারি ক্লাব বেশ বড় হোটেল। স্টার হোটেল। আমরা চোদ্দ তলায় ঘর পেলাম। পর পর তিন রাত এখানে থাকব। ডুলুং- সোহমের সেমিনার আছে নাইরোবি ইউনিভার্সিটিতে দু'দিন। তার পর এখানে থেকে ওয়ান ডে ট্রিপে লেক নাকুরু ও লেক নাইভাসা দেখব। চতুর্থ দিন চলে যাব কেনিয়ার আরও এক বিখ্যাত জঙ্গল - অ্যাম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্কে।

নাইরোবিতে প্রথম রাত ক্লান্ত থাকার দরুণ সুন্দর ঘুমিয়ে কেটে গেল। চোদ্দ তলা থেকে রাতের শান্ত নাইরোবি শহরটাকে একবার দেখেছি। দ্বিতীয় দিন সকালে ডুলুং-সোহম ব্রেকফাস্ট করে চলে গেল ইউনিভার্সিটিতে। হোটেলের কাছেই নাইরোবি ইউনিভার্সিটি। আমার খুব ইচ্ছে ছিল গিয়ে শোনার ওদের প্রেজেন্টেশন, কিন্তু সে সুযোগ রাখে নি কতৃপক্ষ। অগত্যা একা একাই কাটাব দিনটা।

নাইরোবি শহর একা একা ঘোরা খুব সেফ নয়। মেয়ে জামাই বারণ করে গেছে। আমিও শুনে এসেছিলাম একথা । তবু বেড়াতে এসে হোটেলের ঘরে চুপ করে বসে থাকার বান্দাও আমি নই!

শহরটাকে দেখব বলে একাই বেরিয়ে পড়লাম। হোটেলের পাশেই ওভারব্রিজ। ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে গেলে নাইরোবি ইউনিভার্সিটি। ভাবলাম ইউনিভার্সিটিটা একবার দেখে আসি। এইখানে আমার দুই প্রিয়জন আজ সেমিনার অ্যাটেন করছে। আন্তর্জাতিক সেমিনার। বাবা হিসেবে খুব আনন্দ হচ্ছে। গর্ব হচ্ছে!. এমন মুহূর্তগুলো তো জীবনের সেরা সঞ্চয়। একই সেমিনারে মেয়ে - জামাই দুজনেই আছে। এ কম বড় আনন্দ! আজ এই আনন্দ আমাকে একাই নিতে হচ্ছে, আরও একজনেরও এই আনন্দের ভাগ নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সে তো দিন ফুরানোর আগেই কোথায় যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল!..

নাইরোবি ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে পড়লাম। খুব বিরাট নয়। ক্যাম্পাসে অনেক বড় বড় গাছ ও ফুলের বাগান রয়েছে। সবুজ একটা মাঠ আছে। আমি ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে গেলাম মহাত্মা গান্ধীর নামে উৎসর্গীত ভবন- The Mahatma Gandhi Graduation Library ও Mahatma Gandhi Wing। দেখে কি ভালো লাগল। এতদূর আফ্রিকায় এসে গান্ধীজির মূর্তি ও তাঁর নামের ভবন দেখে একজন ভারতীয় হিসেবে বেশ গর্বিত হলাম। সেমিনার চলছে বলে মনে হয় ইউনিভার্সিটির অন্য ক্লাসগুলো বন্ধ। ছাত্র ছাত্রীদের চোখে পড়ল না। আমি একা একা কিছুটা ঘুরে বেড়িয়ে নিলাম। এবার কি করি? ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে ভাবতে ভাবতে হাঁটছি, দেখি পথের ধারে - KENYA NATIONAL THEATRE. তার পাশেই The KENYA CULTURAL CENTRE, The Kenya Conservation Of Music. ঢুকে পড়লাম এখানে অনুমতি নিয়ে। আমাদের একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের মত জায়গাটা। বেশ পছন্দ হলো। প্রতিদিন নাটক হয়। আজও আছে। দুটো নাটক ছিল The Trial Of Dedan Kimathi ( Gutuirwo Kwa Dedan Kimathi) এবং Murang'a Women's Strikes. এখানে একটা পোস্টারও দেখলাম - The 6 th Dance Festival. 


এই থিয়েটার একাডেমির চত্বরেই দেখি একদল যুবক যুবতী আফ্রিকান ড্যান্স প্র্যাকটিস করছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। কি উদ্দাম উচ্ছল সে নৃত্য। সঙ্গীতে কি প্রবল সুর ঝঙ্কার। তাই ওদের শরীরের ভঙ্গিমায় নাচ হয়ে উঠছে শিল্প। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। তার পর নিজের থেকেই আলাপ করলাম ওদের সঙ্গে। আমি ভারতীয় এই পরিচয়টা কয়েকজন মাত্র বুঝল, বাকিরা না বুঝেও আমাকে আপন করে নিয়ে বেশ গল্প করল। ছবি তোলা হলো সবার সঙ্গে। চলে আসার সময় মনটা কেমন যেন করছিল!.. এই হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনার মধুর স্মৃতি ভ্রমণের স্বাদ বদল করে দেয়। আমার ভ্রমণ তাই সব সময়ই স্বাদ বদলের আনন্দে রঙিন থাকে।

এবার থিয়েটার সেন্টার থেকে বেরিয়ে হাঁটছি। ছবি তুলছি। নিছকই ছবি তোলার আনন্দে ছবি তুলছিলাম। চোখে পড়ল কেনিয়া দূরদর্শনের ভবন। সখ করে দুটো দু'রকম ছবি তুললাম। এমন সময় হঠাৎ দেখি দুই সশস্ত্র পুলিশ এসে আমাকে জেরা করতে শুরু করল, "কেন আমি ছবি তুললাম? কি উদ্দেশ্য? কে আমি? কেন এসেছি এখানে?" এমন আরও সব প্রশ্নে আমাকে জেরবার করে তুলল। তার পর আড়ালে ডেকে নিয়ে ভয় দেখিয়ে বলছে, "তোমাকে অ্যারেস্ট করা হবে। চলো।..."

আমি এমন সাঁড়াশি আক্রমণে প্রাথমিক ভাবে একটু ভয় পেয়ে গিয়েও নিজেকে সামলে নিতে পেরেছিলাম। বুঝতে পেরে যাই দুই বাজে পুলিশের খপ্পরে পড়ে গেছি। আসলে ওরা ভয় দেখিয়ে ঘুষ চাইবে। আমি তখন সাহস করে বললাম, "ঠিক আছে। চলো তোমাদের থানায়। আমি এসেছি ইউনিভার্সিটিতে। আমার মেয়ে জামাই আমেরিকা থেকে এসেছে, এই ইউনিভার্সিটিতে পেপার পড়ছে। আর যা বলার বলব থানায়।"

এবার দেখি সুর নরম। ওদের একজন বলল, "ওকে। তোমার পাসপোর্ট দেখাও।"

দেখালাম পাসপোর্ট। এবং মোবাইল থেকে ঐ দুটো ছবি ওদের সামনে ডিলিটও করে দিলাম। এবার ওরা আর কোনও কথা না বলে আমায় ছেড়ে দিল।

এটা একটা বাজে অভিজ্ঞতা। পৃথিবীর সর্বত্রই বোধহয় কিছু এমন বাজে ঘুষখোর পুলিশ থাকে। এমনিতেই শুনেছি, কেনিয়াতে প্রচন্ড পরিমাণে করাপশন আছে। ল অ্যান্ড অর্ডার খুব ভালো নয়। সাবধানে থাকতে বলে ট্যুরিস্টদের। দুটো মামুলি ছবি তোলার জন্য এমন ভাবে প্রতারিত ও বিরক্তির শিকার হব ভাবতে পারি নি!..

এই ঘটনার পর মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। ঘুরে বেড়ানোর মেজাজটা হারিয়ে ফেলি। তার ওপর রাস্তায় অনেক সন্দেহ জনক লোককে দেখতে পাই। সমানে ভিক্ষা চাইছে, "গিভ মি ওয়ান ডলার!" কাউকে কাউকে দেখে মনে হচ্ছিল না দিলে কেড়ে নিতে পারে!

 একা একা শহর ঘোরার সাহস ক্রমশ হারিয়ে ফেললাম। তাই ফিরে এলাম হোটেলে।...

নাইরোবির হোটেলে আজ তৃতীয় দিন। গতকাল সোহমের পেপার প্রেজেন্টেশন ছিল। খুব ভালো হয়েছে। ডুলুং এর আগামীকাল পেপার পড়া। আজ দুজনেরই কিছু নেই। তাই আমরা চললাম ওয়ান ডে ট্রিপে লেক নাকুরু ও লেক নাইভাসা দেখতে। আজ আমরা তিনজন নয়, চারজন। নতুন সঙ্গী নিউইয়র্ক থেকে আসা একজন এমিরিটাস অধ্যাপক। তিনিও ডুলুংদের মতই এই সেমিনারের একজন মাননীয় বিশেষ অতিথি। প্রফেসরের বয়স পঁচাত্তর। সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ান এই সব সেমিনারের কারণে। আজ আমাদের সঙ্গে বেড়াতে চলেছেন। সফর সঙ্গী হিসেবে খুব ভালো পেয়েছিলাম তাঁকে।

মাসা আমাদের একদম ভোরবেলাতেই নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট তখনও ভোরের আলো অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। আজকের ট্রিপটা খুব হেকটিক হবে জানি। নাইরোবি থেকে নাকুরু কম বেশি একশো ষাট- সত্তর কিমি। একদিনে এত বড় একটা জার্নি করে দু'দুটো লেক দেখে আবার নাইরোবিতে ফিরে আসা বেশ পরিশ্রমের ও ক্লান্তির।


প্রথমে দূরেরটা - লেক নাকুরুতে নিয়ে এলো মাসা। আফ্রিকার বিখ্যাত গ্রেট রিফ্ট ভ্যালির মধ্যে পড়ে নাকুরু। এমন আরও কয়েকটি লেক রয়েছে রিফ্ট ভ্যালির মধ্যে -লেক নাইভাসা, লেক এলিমেনটাটা ও লেক বগোরা। আমরা আজ লেক নাকুরু ও লেক নাইভাসা দেখব। বাকি দুটো লেক দর্শন এবারের ভ্রমণসূচীতে নেই!.. "সব পেলে নষ্ট জীবন!.. " এমন একটা গান আছে শুনেছি। কিন্তু সব দেখতে না পেলে কষ্ট ভীষণ!.. আবার এক ভ্রমণে সব দেখা সম্ভবও হয় না। তাই হে পথিক, হে ভূপর্যটক - এক ভ্রমণে যতটুকু যা দেখছো প্রাণ ভরে দেখে নাও!.. দুঃখ কোরো না!..

টিকিট কেটে Lanet Gate দিয়ে লেক নাকুরু ন্যাশনাল পার্কে প্রবেশ করলাম। ১৯৬৮ সালে লেক নাকুরু এই শিরোপা লাভ করেছে। তার আগে লেক নাকুরু পরিচিত ছিল "বার্ড স্যাংচুয়ারি" হিসেবে। এর চারপাশে রয়েছে পাহাড়, জঙ্গল ও জলাভূমি। বিস্তৃত এক অঞ্চল, প্রায় দেড়শো বর্গ কিলোমিটারের বেশি নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে এই পার্ক। এখানেও আমরা গেম ড্রাইভ করলাম। মাসাইমারা বা সেরেংগেটির মত ধূ ধূ সাভানা এখানে নেই। মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়, ঘন জঙ্গল ও ধূলি ধূসরিত পথ। এবং বিশাল এক লেক। 

লেক নাকুরু বিখ্যাত ফ্লেমিংগো ও গন্ডারের জন্য। লাখ লাখ ফ্লেমিংগোদের দেখা পাওয়া যায় গ্রেট মাইগ্রেশনের সময়। ঝাঁক ঝাঁক পিঙ্ক ফ্লেমিংগোদের দেখা সে এক অসাধারণ দৃশ্যসুখ। লেক নাকুরুর জলে এক ধরণের অ্যালগি প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। এই ছত্রাক ও তেলাপিয়া মাছ খেতে দলে দলে ফ্লেমিংগোরা আসে হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে প্রতি বছর। আমরাও অনেক ফ্লেমিংগো দেখলাম। কিন্তু প্রচুর নয়, তার কারণ গ্রেট মাইগ্রেশন শুরু হয় নি। আমরা একটু আগেই চলে এসেছি। অগাস্টের শেষে শুরু হবে গ্রেট মাইগ্রেশন!..লেক নাকুরুতে ফ্লেমিংগো ছাড়াও রয়েছে প্রায় আড়াইশো প্রজাতির পাখি। ঝাঁক ঝাঁক পেলিক্যান দেখেছি। চোখে পড়েছে অনেক স্যাডল বিল্ড স্টর্ক ও ঘাস জমিতে চড়ে বেড়ানো স্টর্ক। ফিশ ঈগল, গ্রে হেরন, পানকৌড়ি, গ্লসি স্টারলিংদের মত আরও কত যে পাখিদের পাঠশালা ছড়িয়ে রয়েছে লেক নাকুরুতে। তাই এই গেম ড্রাইভও ছিল খুব উপভোগ্য।

লেক নাকুরুর গেম ড্রাইভে অনেক গন্ডার দেখার সুযোগ ঘটেছে। বেশ সামনে থেকেই দেখেছি গন্ডারদের। এখানে বেশি দেখা যায় হোয়াইট রাইনোদের। শুনলাম ব্ল্যাক রাইনোরা সংখ্যায় কমে আসছে আফ্রিকার জঙ্গলে। এছাড়া বারবার দেখেছি বেবুন, জেব্রা, ইমপালা, জিরাফ, কেপ বাফেলোদের। 

এবার আমরা জঙ্গলের পথে অনেকটা গিয়ে দেখা পেলাম সুন্দর এক ঝর্ণার - MAKALIA FALLS. এখানে এসে দেখি চার চারটে স্কুল বাস এসেছে। ছোট ছোট ছাত্র ছাত্রীরা খুব মজা করছে। ওদের সঙ্গে আমরাও মেতে গেলাম ঝর্ণা দেখার আনন্দে। বিরাট কোনও ঝর্ণা না হলেও এই সবুজ জঙ্গল ও লাল মাটির আবহে পাহাড়ের ওপর থেকে ঝরে পড়া জলরাশির জলোচ্ছ্বাস দেখতে তখন ভালোই লেগেছে।

বেলা গড়িয়ে দুপুর এখন। এবার লাঞ্চ ঘোষণা করে মাসা আমাদের নিয়ে গেল লেক নাকুরু লজে। এখানেই মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন। জঙ্গলের মধ্যে লেক নাকুরু লজ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। লজের মধ্যে সুন্দর এক মিউজিয়াম ও সুভেনির শপ রয়েছে। বাগানে সুইমিং পুল। ভিউ পয়েন্টও করে রেখেছে কয়েকটা। সেখানে বসলে লেকটাকে সুন্দর দেখতে লাগে। অলস অবসরকে দারুণ ভাবে এই সব ভিউ পয়েন্টে বসে উদয়াপন করা যায়। মনে খুব আফসোস হচ্ছিল, যদি একটা রাত এই লজে থাকতে পারতাম!..

বুফে সিস্টেমে লাঞ্চের আয়োজন ছিল খুব ভালো। সুস্বাদু সব খাবার। ভেজ - নন ভেজ সব সাজানো। ফল ছিল। ফ্রুট জুস ছিল। আইসক্রিম। চকলেটও ছিল। মনের আনন্দে পেট ভরে খেয়ে নিলাম। এখানে দেখলাম আমাদের সঙ্গী অধ্যাপক পুরোপুরি ভেজ খেলেন!..

এবার নাকুরু থেকে বেরিয়ে আমরা চললাম লেক নাইভাসার পথে। সময় লাগবে কম বেশি দেড়-দু'ঘন্টা। 

লেক নাইভাসা বিখ্যাত এর নীল জলের সৌন্দর্যের জন্য। কায়াকের মত ছোট ছোট নৌকোয় চড়ে নৌকোবিহার ও খুব কাছ থেকে জলহস্তিদের দেখা যায় এই লেকের জলে। জলহস্তিরা সপরিবারে জলে ডুব দিয়ে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ মুখ তুলে একটু দেখা দিয়েই লুকিয়ে পড়ে। সেই দুর্লভ ভয়ংকর সুন্দর মুহূর্তের ছবি পেয়ে গেলে তো লা জবাব!.. ভ্রমণ সার্থক।

প্রথম দর্শনেই লেক নাইভাসা আমাদের মন জয় করে নিয়েছিল। কি বিরাট এই নীল জলের লেক। লেকের চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চোখের দেখায় মুগ্ধতা তৈরি করে হৃদয়ে। এই নীল জলে ভেসে বেড়ানোর আনন্দ দারুণ উপভোগ করেছি। লেকের আয়তন কম বেশি একশো পনেরো বর্গ কিলোমিটার। লেকের চারপাশে প্যাপিরাস, ইয়েলো ফিভার গাছ ছড়িয়ে রয়েছে। জলের অতলে অনেক মরা গাছের গুড়িও দেখেছি। সেই সব গাছের ডালে কত পাখি যে বসে থাকে। কি সুন্দর লাগে সে দৃশ্য। ছবি তুলে মন ভরে যায়। নাইভাসায় বহু প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায়। বড় বড় পেলিক্যান দেখেছি। কিংফিশার দেখেছি। 

লেকের জলে ভাসতে ভাসতে ওপারে চলে গিয়ে "নেচার ওয়াক" করলাম। এর জন্য আলাদা করে কুড়ি ডলার খরচ হলো এক একজনের। সঙ্গে একজন গাইড ছিল। খোলা জঙ্গলে গাইডের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে খুব কাছ থেকে অনেক জেব্রা, জিরাফ, ইমপালাদের দেখলাম। আফ্রিকার জঙ্গলে পায়ে হেঁটে ঘোরার একটা আলাদা থ্রিলিং অনুভব করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ উড়ো মেঘে বৃষ্টি এসে সব বানচাল করে দিল। সে ভাবে পারলাম না শেষ করতে পায়ে হেঁটে জঙ্গল সাফারিটা। মনে আফসোস নিয়ে নৌকোয় এসে বসলাম। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়েই চলেছে। খোলা নৌকো। কোনও ছাউনি নেই। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফিরে চলেছি ঘাটের কাছে। জলে জলহস্তিররা জলখেলা করেই চলেছে। কত আর দূরে ওরা! আমাদের স্পিড বোটটা বেশ গতি নিয়েই ছুটতে শুরু করল। বৃষ্টির হাত থেকে বেঁচে তাড়াতাড়ি ফেরার জন্যই বোধহয়। একটু যে ভয় করছিল না, তা বলব না। যথেষ্ট ভয় করছিল, জলহস্তিরা তো কয়েক হাত দূরেই!.. নৌকো যদি উল্টে যায় একবার, জলহস্তিদের আজকের ডিনার জমে জমজমাট হয়ে যাবে!..


একদিনের ভ্রমণে নাইরোবি থেকে লেক নাকুরু ও লেক নাইভাসা দেখে ফেরাটা খুব হেকটিক হলেও আনন্দ পেয়েছিলাম অনেক। সেই আনন্দের স্মৃতিকথা অক্ষরে অক্ষরে সাজিয়ে দিলাম সবার জন্য। আনন্দ ভাগ করে নিলে আনন্দ বাড়ে বৈ কমে না!. আনন্দই জীবন!.. এই জীবনটা এভাবেই আনন্দ করে বাঁচতে চাই!..


আগামী সংখ্যায় সমাপ্ত...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register