- 72
- 0
মুসোমা থেকে সেরেংগেটি - প্রথম দিনের গেম ড্রাইভ - থর্ন ট্রিতে রাত্রিবাস...
আজ পৃথিবী বিখ্যাত এক বিরাট জঙ্গলে বেড়াতে যাব!..ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই মনে পড়ল এই কথাটা। এ জঙ্গল তানজানিয়ার সম্পদ। আর জঙ্গল প্রেমীদের স্বর্গোদ্যান।
নাম-সেরেংগেটি!.. সেরেংগেটি মাসাই শব্দ। এসেছে "সিরিঙ্গিত" থেকে। অর্থ হলো- Endless Land. সোয়াহিলি ভাষায় - Hifadhi Ya Serengeti..
সেরেংগেটি সব অর্থেই বিরাট, বিশাল এক অরণ্য। মহারণ্য। আয়তনে মাসাইমারার তিনগুণ। তানজানিয়ার এই জঙ্গল National Park এর মর্যাদা পায় ১৯৪০ সালে।
আফ্রিকা মহাদেশে পৃথিবী বিখ্যাত ৮ টি ন্যাশনাল পার্ক রয়েছে -
১. ভলকানোস ন্যাশনাল পার্ক - রুয়ান্ডা
২.সাউথ নুয়াংওয়া - জাম্বিয়া
৩. সেরেংগেটি - তানজানিয়া
৪. মাসাইমারা - কেনিয়া
৫. অ্যাম্বোসেলি - কেনিয়া
৬. লেক নাকুরু- কেনিয়া
৭. ওকাভাঙ্গো ডেল্টা - বতসোয়ানা
৮. ক্রগার - সাউথ আফ্রিকা
সেরেংগেটি তানজানিয়ার গর্ব। অহংকার। প্রতি বছর সারা বিশ্বের কয়েক লক্ষ পর্যটক এসে ভিড় করেন এই অসাধারণ অরণ্যভূমিতে।
গতকাল অপরাহ্নে আমরা এসে পৌঁছেছিলাম কেনিয়ার সীমান্ত জনপদ ইসেবানিয়া থেকে মুসোমার মাতিল ভিলায়। তার পর থেকে রাত পর্যন্ত এক অফুরান আনন্দে কেটেছে। বিকেলে ভিক্টোরিয়া লেকে নৌকোবিহার দারুণ উপভোগ করেছি। এমন এক নীল হ্রদে একটা বিকেল কেমন মায়াবী আনন্দে কেটে গেছে। সন্ধ্যায় মাতিল ভিলায় নাচ গানের মৌতাত বসেছিল। স্থানীয় আদিবাসী গোষ্ঠীর বিয়ের রিসেপশন। খুব হুল্লোড় আনন্দ। খুব কাছ থেকে শুধু নয় একদম জড়িয়ে গিয়ে ওদের খানাপিনার সঙ্গে আমাকেও নাচ করতে হয়েছে গানের তালে তালে। আফ্রিকান লোক গান দারুণ ঝঙ্কারে বাজছিল। শরীর মনে সহজেই দোলা লেগে যায়। কয়েক মাস আগে ভুটানে বেড়াতে গিয়েও আমার এমন লোকগানের সঙ্গে নাচের অভিজ্ঞতা হয়েছে। নাচ তো কোনওদিন শিখি নি। করিও না কোথাও নিজের চেনা পরিমন্ডলে। কিন্তু এমন বিদেশ বিঁভুইয়ে অচেনা মানুষজনদের সঙ্গে নাচের আনন্দ আমি খুব উপভোগ করি। এখানে আলাপ হয়েছিল অনেকের সঙ্গে। একজনের কথা বলতেই হয়, নাম তার Asteria। আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ সুন্দরী। সে তানজানিয়ার রাজধানী দারুসসালামে থাকে। আত্মনির্ভরশীল মহিলা। Asteria বলল, "তোমার দেশের নাম শুনেছি, কিন্তু আর কিছু জানি না!." খুব সরল স্বীকারোক্তি। আমি দু'একটা কথা বললাম আমার স্বদেশের। কয়েকজন মনীষীর নামও বললাম। দেখলাম ও গান্ধীর নাম শুনেছে!..তার পর অনেক গল্প হলো। সেই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় ঐ দূর বিদেশে এক অচেনা বিদেশিনীর সঙ্গে আন্তরিক আলাপ পরিচয়ের স্মৃতিটুকু রয়ে গেছে আমার মুসাফির জীবনে কুড়িয়ে পাওয়া চোদ্দআনার ঝুলিতে!..
মুসোমা থেকে সেরেংগেটির গেট পথ বেশি নয়। সুন্দর সড়কপথ। গাড়ি ছুটছে। আমরা এই গেট দিয়ে ঢুকে দু'দিন জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়ে রাত্রিবাস করে অপর প্রান্তের NAABI GATE দিয়ে বেরিয়ে চলে যাব আরও এক বিখ্যাত জঙ্গল গোরোংগোরো ক্রেটায়।
মুসোমা শহর ছাড়িয়ে যত এগিয়ে চলেছি সেরেংগেটির দিকে, মন প্রাণ কেমন চঞ্চল হয়ে উঠছে। আজ জীবনের আরও এক অন্যতম ভ্রমণের স্বাদ নেব। দু'চোখ ভরে দেখব পৃথিবীর এক সেরা জঙ্গলকে। এবারও পথের ধারের চিত্র এক। সেই লাল মাটি, চাষজমি, আদিবাসী কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, দূরে অল্প পাহাড়, মাঝে মাঝে হাট বাজার, স্কুল, জলাশয়। এ বড় চেনা সব কিছু আমাদের চোখে - নিজের রাজ্যেই তো রয়েছে আদিবাসী জনজাতি মানুষজনদের এমনই সব গ্রাম,পথ-ঘাট।
সেরেংগেটির গেটের কাছে এসে গাড়ি থামল। ছোট্ট বিরতি। জুলিয়াস গেল টিকিট সংগ্রহ করতে। আমরা একটু পায়চারি করে নিলাম। ফটোসেশানও হলো।
গেটের মধ্যে কোনও চাকচিক্য, বড়ো সড়ো কিছু নেই। সাধারণ একটা গেট। এই গেট দিয়েই টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হবে সেরেংগেটির মহারণ্যে।
গেটের কাছে কয়েকটা ফলক রয়েছে। তেমন একটা ফলকে দেখলাম লেখা -Welcome To NDABAKA ENTRANCE GATE, অন্য একটা ফলকে গর্বিত ঘোষণা খোদাই করা রয়েছে - World Travel Awards Winner- 2019, 2020, 2021, 2022 পর পর চারবার সেরার শিরোপা সেরেংগেটির মুকুটে! এবং আরও একটায় লেখা - " Africa’s Leading National Park, serengeti National Park ( Serengeti Shall never die). এই সব ফলকের পাশে কিছু মৃত প্রাণীদের ফসিল সাজিয়ে রাখা রয়েছে। এগুলো দেখতে বেশ অন্যরকম লাগে। হাল্কা থ্রিল অনুভব হয়। রোমাঞ্চ জাগে মনে। ছোটদের তো দারুণ লাগবে।
জঙ্গলে প্রবেশের ছাড়পত্র নিয়ে জুলিয়াস চলে এলো। গেটের অদূরেই আকাশিয়া গাছের ছায়ায় খড় জাতীয় ঘাস দিয়ে ঢাকা বাঁশবাড়ির মত সুন্দর একটা কফি শপ চোখে পড়ল- MBAYUWAYU COFFEE SHOP. খুব ইচ্ছে করছিল, এক কাপ কফি খেয়ে গেম ড্রাইভটা শুরু করলে হয় না!..
"না। তুমি চলো এখন। অনেক দেরী হয়ে যাবে। গাড়িতে ওঠো।" মেয়ের শাসনে বন্দী হয়ে উঠে পড়লাম ল্যান্ড রোভারে।
চলো মন সেরেংগেটি!.. নো হাঁটাহাঁটি!.. গেম ড্রাইভ মানেই রাজা বাদশাদের মত মেজাজি ভ্রমণ- তোমার ল্যান্ড ক্রুজার বা ল্যান্ড রোভার তখন রথের মতই মর্যাদা পায়!..
সেরেংগেটির Ndabaka Entrance Gate দিয়ে ঢুকে অনেকটা পথ যাওয়ার পর পেলাম উন্মুক্ত সাভানার ধূ ধূ প্রান্তর। আজ আকাশ খুব সুন্দর নীল হয়ে আছে। উজ্জ্বল ঝকঝকে চারপাশ। মিষ্টি বাতাস বইছে। এমন পরিবেশে গেম ড্রাইভের মজা দারুণ উপভোগ করা যায়।
প্রথমেই পেয়ে গেলাম থমসন গ্যাজেলের দলকে। ওরা মনের সুখে আপন খেয়ালে চরে বেড়াচ্ছে। ঘাস পাতা চিবোচ্ছে। সকালের ঝলমলে রোদে ওদের যেন আরও সুন্দর লাগছিল। শুধু তো দেখা নয়। ছবিও তোলা হচ্ছে সমানে। মোবাইলের গ্যালারি উপচে পড়ছে ছবিতে।
এর পর হঠাৎ চোখে পড়ে গেল কেমন নিশ্চুপ হয়ে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা এক মস্ত বড় হাতিকে। ডুলুং এর চোখেই প্রথম ধরা পড়ে। আমাদের গাড়ি সামান্য এগিয়ে গিয়েছিল, জুলিয়াস গাড়িকে ব্যাক গিয়ার করে হাতির কাছাকাছি এনে দাঁড় করাল। ভাবতে অবাক লাগে মাত্র কয়েক হাত দূরে জঙ্গলের উন্মুক্ত হাতি দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের ভয়ও করছে, তবু সাহস করে ওর দিকে তাকিয়ে ছবি তুলছি। দেখে মনে হচ্ছিল ওর বুঝি পূর্বরাগ পর্ব চলছে!.. কেমন অভিসারে আসার মত ঝোপঝাড়ের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে অপেক্ষা করছে, ওর প্রিয়তমা বুঝি এখানেই আসবে!..তখন হয়তো আজকের বাউল বাতাসে এ গানই বাজবে,' মিলন হবে কত দিনে, ও আমার মনের মানুষের সনে!..'
এবার চোখে পড়ল বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আগুনে পোড়া ন্যাড়া জমি। জুলিয়াস বলল, "এগুলোতে আগুন লেগেও যায় আবার কখনো আগুন ধরিয়েও দেওয়া হয়। এখানে অনেক বেবুন খেলা করছে। বাঁদরের মত প্রাণী বেবুনরা লাফালাফি করে বেশ নিজেদের মধ্যে মজা করছে। ওদের এমন মজা দেখে আমাদেরও খুব মজা- এসেছিই তো এমন নির্মল আনন্দ দৃশ্য দেখতে ও সুখস্মৃতি কুড়োতে।
কিছু পরেই ইমপালার দল চোখে পড়ল। মাসাইমারার গেম ড্রাইভ করে এসেছি বলে জঙ্গলের বন্যপ্রাণীদের চট করে দেখতে ও চিনতেও পারছি। আর সেরেংগেটির এই বিশাল জঙ্গলে বন্যপ্রাণও অনেক। গেম ড্রাইভ করতে করতে ওদের সঙ্গে বারংবার দেখা হবেই হবে।
এরপর জেব্রা দেখলাম। জেব্রার গায়ের সাদা- কালো ডোরাকাটা দাগের জন্য জেব্রা দেখতে যেন আরও ভালো লাগে।
পাখি তো একটু পর পর দেখছি। পুঁচকে পু্ঁচকে সুন্দরী পাখি রোলার অসংখ্য। যেমন ওরা ছটফটে তেমন ওদের নাচন! খুব মজা লাগে ওদের দিকে তাকালে। অনেক আকাশিয়ার ডালে পাখির বাসাও ঝুলছে। পক্ষী প্রেমী ও বার্ড ওয়াচারদের জন্য এসব জায়গা একেবারে আদর্শ আনন্দ বিনোদন।
এবার জিরাফ চোখে পড়ল। আকাশিয়া গাছের ডালে গলা উঁচু করে জিরাফকে পাতা চিবোতে দেখে বেশ লাগছিল। এসব দৃশ্য শুধু এত কাছ থেকে নিজের চোখে দেখার আনন্দেই মন ভরে যায়।
সেরেংগেটির অসীম অনন্তে চোখ হারিয়ে ফেলে দৃষ্টির সব সীমাকে! দূর বহুদূরে তাকিয়ে আছি, এমন অসীমের কাছে মনে হয় আগে কোনওদিন আসার সৌভাগ্য হয় নি। কী আনন্দ, কী ভালোলাগা যে জন্ম হয় হৃদয়ে, শুধুই তো বন্যপ্রাণ দেখা নয়, এমন এক অনন্ত অসীম অরণ্যকে দেখাও এক বিরাট প্রাপ্তি।
সেরেংগেটির বিগ ফাইভ- হাতি, সিংহ, রাইনো, লেপার্ড ও কেপ বাফেলোর গল্প আসার আগে অনেক শুনে এসেছি। যদিও এই বিগ ফাইভ বাছা নিয়ে অনেক দ্বিমত আছে। কেন এরাই শুধু হবে বিগ ফাইভ !.. এসব সেই সাদা চামড়ার শাসকদের পছন্দের তালিকা। যখন তারা এই দেশটাকে শাসন করত, শিকার করত, লুঠ করত, তাঁরা তাঁদের পছন্দের প্রাণীদের বিগ ফাইভ বলে আদর করে ডাকত!..যাই হোক, আমরা মাসাইমারায় হাতি, সিংহ, কেপ বাফেলো দেখে এসেছি। দেখা হয় নি রাইনো ও লেপার্ড। জুলিয়াস বলল, লেপার্ড দেখার জন্য খুব লাক ফ্যাক্টর কাজ করে। রাইনো এখানে না পেলেও গোরোংগোরোয় পাওয়া যাবে।
গেম ড্রাইভ করতে করতে বেলা বয়ে যায়, এ এক মজার বনভ্রমণ। খিদে পায়। তৃষ্ণা পায়। কিন্তু বিরক্তি আসে না। খেয়ে নিয়ে আবার চাঙ্গা হয়ে পড়ো। লেটস গো.. শুরু হয় আবার পথে পথে ছুটে বেড়ানো। সব পথই নতুন। সব পথই রোমাঞ্চকর। পথে শুধু আমাদের ল্যান্ড রোভার বা ল্যান্ড ক্রুজার ঘুরে বেড়াচ্ছে তা নয়, স্কুল বাসও আছে। বাস ভর্তি করে ছাত্র ছাত্রীর দল চলে এসেছে গেম ড্রাইভের আনন্দ উপভোগ করতে। তেমন একটা স্কুল বাস চোখে পড়ল- The Roman Catholic Diocese School.
পরিচিত হলুদ রঙের স্কুল বাস। বাসের সামনে দেখলাম লেখা- TATA. আফ্রিকার জঙ্গলে এসেও টাটার স্কুল বাস দেখে বেশ আনন্দ হলো। স্কুল বাসটা আমাদের সামনে আসতেই হাত নেড়ে টা টা করলাম, বাস ভর্তি ছাত্র ছাত্রীরা "জাম্বো জাম্বো, কারিবু "বলে চিৎকার জুড়ে দিয়ে আমাদের দিকে হাত নাড়তে শুরু করল। আহা!.. কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!..
সেরেংগেটির গভীর জঙ্গলে পেট্রোল পাম্প রয়েছে। এয়ার স্ট্রিপ রয়েছে। আমরা তেমন এক পেট্রোল পাম্পে গাড়ি থেকে নামলাম, ওয়াশরুম ব্যবহার করার জন্য।
জুলিয়াস খুব অভিজ্ঞ চালক এবং জঙ্গল বিশারদ। জানকারি আছে সেরেংগেটি সম্পর্কে। শুধু তো বন্যপ্রাণ নয়, এই জঙ্গলের অনেক গল্পও আছে। সে সব গল্প টুক টুক করে বলে। শুনতে ভালো লাগে। সমৃদ্ধ হই। ভ্রমণে আসা তো নিজেকে একটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়ারও একটা পাঠ!..রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, থেটারে লোকশিক্ষা হয়!.. ভ্রমণেও তেমন একটা জগৎ শিক্ষা লাভ হয়!.
এবার হঠাৎ চোখে পড়ল পর পর তিনটে সাফারি জিপ। তিনটে গাড়িতেই বিদেশী পর্যটক। ওরা নিজেরাই ড্রাইভ করছে। এই প্রথম এমন অভিজ্ঞতা হলো। এমন গভীর অচেনা জঙ্গলে পর্যটক নিজে গাড়ি চালিয়ে গেম ড্রাইভ করছে! তিনজন চালকের একজন আবার মেম সাহেব। ওরা জুলিয়াস এর থেকে অনেক রাস্তা ভালো করে জেনে বুঝে নিল। জানতাম না এভাবেও অনুমতি পাওয়া যায় জঙ্গলে বেড়ানোর।
দিন শেষ হবে হবে। প্রথম দিনের গেম ড্রাইভও ফুরিয়ে আসছে। জুলিয়াস হঠাৎ ফোনে কি এক বার্তা পেয়েই গাড়ি ঘুরিয়ে ছুটল... ছুটতে ছুটতে এসে থামলাম একটা মস্ত বড় আকাশিয়া গাছের ঠিক তলায়.. কেন এখানে এলাম বুঝতে না বুঝতেই চমকে গিয়ে দেখি আমাদের ঠিক মাথার ওপরে সিংহীর লম্বা লেজটা দুলছে!.. গাছের ডালে সিংহী মহারাণী নিদ্রায় মগ্ন!.. ভয়ংকর অভিজ্ঞতা!.. কোনও কারণে আচমকা যদি মহারাণী গাছের ডাল থেকে স্লিপ খেয়ে পড়ে যায় তো পড়বে একদম আমাদের গাড়ির ওপর!.. জুলিয়াস খুব দুঃসাহস দেখিয়েছিল এটা!.. আমরা প্রথমে তো মুগ্ধ হয়ে দেখলাম, শুধু দেখলাম, তারপর অনেক ছবি তোলা হলো। গাড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছবি নেওয়া হলো। নানা ভঙ্গিতে ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মুখ দেখতে পেলাম না। মহারাণী মুখ লুকিয়ে কী গভীর ঘুমে ডুবে ছিলেন যে আমাদের উপস্থিতি টেরই পেলেন না!..
আকাশে হঠাৎ করে কালো মেঘ উড়ে এলো। প্রথমে টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি হলো। তারপর তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বৃষ্টিতে ভিজে একপাল হাতি এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাচ্ছে। কয়েকটা জেব্রাকে দেখলাম আকাশিয়া গাছের তলে দাঁড়িয়ে পড়েছে বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য বুঝি!..
সকাল থেকে অনেক বেড়ানো হলো। মন প্রাণ ভরে গেছে। চক্ষু সার্থক। বন্যপ্রাণ অনেক দেখেছি। বারবার দেখেছি। শেষ বেলায় এমন সিংহীরও দেখা পেলাম। এবার ক্লান্ত শরীর একটু বিশ্রাম দাবী করছে। জুলিয়াস জানাল, আমাদের নাইট স্টে আজ একদম গভীর জঙ্গলের ক্যাম্প টেন্টে। সেই টেন্ট প্রায় এসে গেছে। জানি টেন্টের নাম -"থর্ন ট্রি।" আকাশিয়া গাছের মতই দেখতে এক ধরনের গাছ - থর্ন ট্রি। আরও একটা নাম আছে আকাশিয়ার ইয়েলো ফিভার ট্রি।
সত্যিই এক গভীর জঙ্গলের মাঝখানে দেখি পর পর কয়েকটা তাঁবু। দূর থেকে দেখেই বুঝলাম, ঐ আমাদের থর্ন ট্রি ক্যাম্প। দেখেই রোমাঞ্চ জাগল মনে!.. চারপাশে ধূ ধূ প্রান্তর। বহুদূরে পাহাড়। ঢালু এক উপত্যকা। কোথাও কোন বেড়া নেই। ফেন্সিং নেই। নিরাপত্তার বাড়বাড়ন্ত নেই!.. একটু ভয়ও করল। জুলিয়াস ধীরে ধীরে থর্ন ট্রির দিকে এগিয়ে চলেছে। দিনের সূর্য টাল খেয়ে গেছে পশ্চিমে। বৃষ্টি ধোঁয়া আকাশ অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছি সেই আকাশকে!..আর হাত দশ পনেরো দূরে আমরা থর্ন ট্রি থেকে, ডুলুং হঠাৎ বলল, " হায়েনা! হায়েনা!"
সোহম ফিস ফিস করে বলল, " হ্যাঁ। তিন তিনটে হায়েনা!.."
আমিও হায়েনাগুলোকে দেখলাম। জঙ্গলের খতরনাক জন্তু। লেপার্ডরাও নাকি ওদের ভয় পায়। ওরা তিনটে দল বেঁধে বেলা শেষের কম আলোয় ঘুরে বেড়াচ্ছে শিকার ছিনতাইয়ের জন্য আমাদেরই টেন্টের কাছাকাছি। ওদের বদ স্বভাব হলো, ওরা শিকার করে না। শিকার চুরি করে খায়!..
আমি জুলিয়াসকে বললাম, "জুলিয়াস এই টেন্টে থাকা সেফ তো!.."
জুলিয়াস শিশুর মত হাসল। তার পর বলল, "হাকুনা মাটাটা!.."
আমরা জানি হাকুনা মাটাটা সোয়াহিলি শব্দ। মানে হলো "নো প্রবলেম!.."
থর্ন ট্রি র কাছে এসে গাড়ি থামতেই, টেন্টের তিনজন কর্মী আপ্যায়ন করে এগিয়ে এসে বলল, "জাম্বো জাম্বো, কারিবু।" তারপর সুন্দর করে হেসে বলল, ''হ্যালো, হ্যালো, ওয়েলকাম!.."
আমি চকিতে দেখে নিলাম, ওদের একজনের কোমরে রিভলবার রয়েছে!..
ক্রমশ...
0 Comments.