Wed 05 November 2025
Cluster Coding Blog

|| কালির আঁচড় পাতা ভরে কালী মেয়ে এলো ঘরে || T3 26য় পায়েল চট্টোপাধ্যায়

maro news
|| কালির আঁচড় পাতা ভরে কালী মেয়ে এলো ঘরে || T3 26য় পায়েল চট্টোপাধ্যায়

"সত্যি নয়, গল্প''

প্রিয় সত্যবতী,
কেমন আছো?কোথায় আছো? এখনো 'কথা' বলো বুঝি আগের মত? আচ্ছা, গ্রামের সেই 'ছায়ান্ধকার পুষ্করিণী'র ধার-এর কথা মনে আছে? ‘নেড়ু’, পুণ্যি, এদের কথা মনে পড়ে? নিভৃতবাসিনী হয়ে কেমন অনুভূতি হয়েছিল! কি ভাবছ! অন্তপুরের সেই জেদি, একবগ্গা সত্যবতীকে সকলে ভুলে গেছে? ভুল! সুবর্ণলতা, বকুল সকলের মধ্যেই গেঁথে রয়েছে এক টুকরো সত্যবতী। কি করে? প্রান্তিক গ্রামের এক পুষ্করিণীর ছোট্ট স্রোত যেভাবে মহান সমুদ্রে গিয়ে মেশে! যে স্রোত জন্ম দেয় এক বিরাট নদীর! যে নদীর শাখানদী ও উপনদীরা ভাঙন রোধ করে করে গড়ে দেয় আশার নীড়! সত্যবতীর খুঁজে দেওয়া পথ ছিল বলেই অজস্র বকুল, পারুলরা সংগ্রাম করতে পেরেছিল।

শৈশব আর কিশোরীবেলার সীমারেখা জুড়ে যে পথ খোলা ছিল, তাতে আঁজলা ভরে কি নিয়েছিলে? আনন্দ, দুঃখের মতো সহজ অনুভূতি! নাকি ধুলোমাখা, মরুভূমি-সমান জীবনে পায়ের তলার শক্ত জমির সন্ধান। যে জমিতে সুবর্ণলতারা গড়ে ওঠে। যেখানে বকুল ফুলের চারা রোপণ হয়।

পড়াশোনা করো নিশ্চয়ই এখনো? লুকিয়ে পড়তে হয় না বোধহয় আর। সেই 'বৌ-ঠ্যাঙানো' দাদাকে নিয়ে ছড়া-বাঁধার কথাটা মনে পড়লে কেমন অনুভূতি হয়? স্মৃতিপটে কি ভেসে ওঠে? ধুলোমাখা পা নিয়ে দৌড়ে আসা এক কিশোরী! মাথা ভরা কোঁকড়া চুল, গভীর চোখের এক দস্যি মেয়ে! যার বাক্যি’র ঠেলায় প্রমাদ গোণেন সকলে। বাবুই পাখির বাসা ধরে আনা, কাঁচপোকাদের নিমেষে ধরতে পারার ক্ষমতা কজনেরই বা থাকে! তবে এসব ক্ষমতা ক্ষমা-ঘেন্না করে মেনে নেওয়া গেলেও যা মানা যায় না, তেমন এক ক্ষমতা ছিল তোমার! তালপাতায় কলম দিয়ে অক্ষর লেখার ক্ষমতা! তাও আবার ‘মেয়েমানুষ’ হয়ে! সেদিন ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিলে বল! পাছে মেয়েমানুষের পড়ালেখার কথা জেনে ভর্ৎসনা করে সকলে। ওই যেদিন নেড়ু প্রথমবার তোমার রাশভারী, দৃঢ় চরিত্রের পিতাকে এক মেয়েমানুষের লেখাপড়ার কথা জানিয়ে দেয়! অন্তপুরের কানাকানি! ভর্ৎসনা যে জোটেনি তা নয়! তবে সেই মানুষটার কাছে জোটেনি। লোকের কথায় যার আদরে 'সারাদিন ধিঙ্গিপনা করে বেড়ায় সত্য', সে দিব্যি খুশি হয়েছিল। তাই 'মেয়েমানুষের লেখাপড়ার ফলে অনিষ্ট হবার ভয়ে' মায়ের বাঁধ না মানা অশ্রুও 'কঠিন সত্য'র মন গলাতে পারেনি। 'অপরাধিনী'র বেশে বাবার কাছে যাওয়া। পরেরটা আশা করনি বোধহয়! সেদিনই আলো জ্বলেছিল বল! বাবা খুশি হলো লেখাপড়ার কথা শুনে। নিজের তালপাতা, কলম এল। সেদিন অমূল্য জিনিস পেয়েছিলে। মেয়েমানুষের লেখাপড়ার অধিকার! মুহূর্তের সুখ নাকি সুখের অনন্ত পথ! সে যুগেও মেয়েমানুষের 'নিজের জন্য নির্দিষ্ট করা এক টুকরো সময়'। এ বোধহয় কারোরই ছিল না! 'সত্যবতী'র ছিল বলেই সত্যবতী 'আকাশের পাখি' হতে পেরেছিল! পুণ্যির মত 'খাঁচার পাখি' নয়!

নিজের বাপের জন্যেই 'সত্যবতী' এমন আলোর মতো হয়েছিল! লোকে যদিও উল্টো বলতো। তুমি মনে মনে বাবাকে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করতে। তবুও সেদিন সেই বাপ-এর সঙ্গে তর্ক জুড়েছিলে। জ্যেঠতুতো দাদার দ্বিতীয় বিয়ে দেবার জন্য। সতীন-কাঁটা নিয়ে প্রশ্নে তোমার মন উথাল-পাথাল। বাবাকেও সেই প্রশ্নে জর্জরিত করেছিলে! মনে পড়ে সে সব? বাবার মনে তখন দস্যি 'সত্য'র ছবিটা ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে! দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। তবুও স্নেহচ্ছায়া দিয়ে আগলে রাখতে ত্রুটি করেননি। সেই বাবার কাছে কত প্রশ্ন ছিল তোমার? 'উত্তুর' পেয়েছিলে সেসবের?

তারপর তোমার এসবের পালা চুকলো। নারী জীবনের গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়ার পথে এগিয়ে যাওয়া। তবুও ফুলে ফুলে কেঁদে উঠেছিল! ‘পরগোত্তর’ হয়ে যাওয়ার যন্ত্রনা। তোমার ভেতরে তখন তোলপাড়! তবুও শান্ত, সমাহিত সত্যবতী! আসলে ভেসে যাওয়ার মানুষ তুমি কোনদিনই ছিলে না! শুধু মাঝে মাঝে জীবনের ঝড় তছনছ করেছে তোমায়। ভেঙেছে খানিক, গড়েছে অনেকখানি।

তখন তুমি বিবাহিত কিশোরী। সংসারের কোনো আকর্ষণ নেই। তবুও রয়েছো। বাধ্য, নম্র সত্যবতী। তবে কখনো কখনো এক ধাক্কায় যেন বেরিয়ে আসে মুক্ত আকাশের সত্যবতী। দৃঢ়, বলিষ্ঠ, তেজী, জেদি। নিয়মের বাঁধনে যাকে বাধা যায় না।

তবুও কখনো কখনো বাঁধা পড়েছ। আঁতুড়ঘরে সন্তান কোলে নিয়ে মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনেও চোখ থেকে জল পড়েনি। অমোঘ নিয়তি আর নিয়মের যুদ্ধ। বাবার প্রতি এখনও অভিমান হয়? কেন 'আট বৎসর পার হতে না হতেই' সে তোমায় 'পরগোত্তর' করে দিল! বিয়ের পর যে অসীম শূন্যতা তোমায় গ্রাস করেছিল, আর তার সবটুকু অভিমান বাবার উপর উজাড় করে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল, সেসব উত্তর নিজের কাছে দিয়েছিলে? নাকি ভেতরে শুধুই যন্ত্রণার পাহাড় বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছো? পরিবারের মানুষের চারিত্রিক ত্রুটি শুধরে দিতে না পেরে নিজে মনোকষ্টে ভুগেছো! তবু মুখ ফুটে জানাতে পারোনি ভেতরের দ্বন্দ্বের কথা! কোথায় লুকোতে তাদের? আকাশের আড়ালের মেঘটা কেউ দেখতে পেত? অভিমানী সত্যর দৃঢ় সত্তাই কি সুবর্ণলতার পাথেয় ছিল? খোঁজ নিয়েছিলে? তবে তার জন্য তোমার 'মন নেয় না' এমন কাজ কি করতে হয়নি? প্রিয় 'ঠাকুরঝি'র ওপর তোমার শ্বশুর বাড়ির অত্যাচার মেনে নেওয়া, কখনো স্বামীর অন্যায় আবদার মেনে নেওয়া, এসবই কি ‘মনে নেওয়ার কাজ’ ছিল? সুবর্ণর বিয়ে আটকাতে না পারলেও, এক টুকরো 'সত্যবতী' গেঁথে দিয়েছিলে তার মধ্যে!

তবে তুমি কি ভেবেছো আজ বোধহয় সব পাল্টে গেছে? সত্যবতীরা ইচ্ছেমতো বাঁচার স্বাধীনতা পেয়েছে? এই ভেবে নিশ্চিন্ত হয়েছে বুঝি? ভুল! আজও নিভৃতে সত্যবতীরা সহ্য করে! ইচ্ছে, অনিচ্ছের সুতোয় ঝুলতে থাকে ওদের জীবন। সংসার নামের খেলাঘরে বন্দী। সত্যবতী বিস্মৃত নয়। যন্ত্রণারা জেগে থাকে। কোথাও দৃশ্যমান, কোথাও নিভৃতে। সেই একই সূর্য আজও ওঠে। অন্ধকারকে জানান দিতে। 'কাল' বদলেছে। তবুও যন্ত্রণা, 'হাঁসফাঁস করতে থাকা ইচ্ছেরা' আজও আছে। কোথাও কোনো 'সত্যবতী' হয়তো আকাশের মত সাহস যোগায়! তাদের অনুভূতি-গাথা কেন পৌঁছয় না আমাদের কানে? বলতে পারো? নিভৃতে সত্যবতীরা আজও হয়তো সংগ্রাম করছে বকুলদের জন্য , সুবর্ণলতার জন্য। আচ্ছা এমন দিন কি আসতে পারে না, যেদিন সত্যবতী মুক্ত আকাশ পাবে, যন্ত্রণা বুকে নিয়ে আর তাকে বলতে হবে না, 'মেয়ে জন্মটা ছাই'। এমন দিন কখনো এলে তুমি আবার সেই ধুলো-মাখা পায়ে আঁচল উড়িয়ে ছুটে আসবে তো!

                            ইতি
              সুবর্ণলতা ও বকুলরা
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register