Tue 28 October 2025
Cluster Coding Blog

T3 || ঘুড়ি || সংখ্যায় অন্তরা দাঁ

maro news
T3 || ঘুড়ি || সংখ্যায় অন্তরা দাঁ

ভো-কাট্টা তোমার ভালোবাসা...

সেই যে কোন ছোটবেলায় পড়েছিলাম শিশুপাঠ্যে _ 'কতদিন ভাবে মেঘ উড়ে যাব কবে যেথা খুশি সেথা যাব ভারি মজা হবে '... মেঘের মতই উড়তে চেয়েছিলাম আমরা সবাই।জেনারেশন আলফা অলরেডি ইন তবুও এখনো মোমবাতি, বগগা, পেটকাটি,চাঁদিয়ালে ব্লক-প্রিন্টেড হয়ে থাকে আকাশের নীল জমি, বিশ্বকর্মা পুজোর সিগনেচার টোনে বাজে ভাদ্র-সংক্রান্তির ঘুড়ি ওড়ানো। ইদানীং বঙ্গসংস্কৃতির 'অ আ ক খ' তে প্রাদেশিক কালচার ঢুঁ মেরে এন্ট্রি নিয়ে নিলেও, যতই 'গণপতি বাপ্পা মোরিও' বলে গণুবাবার পুজোয় আমরা 'মোদক' খেয়ে সেলিব্রেশন করি, ঢাকে কাঠি ঠিকমতো পড়লো কিন্তু এই বিশ্বকর্মা পুজোর হাত ধরে। আর তাতে শিলমোহর দিলো পাতলা ফিনফিনে কাগজের ঘুড়ি। একখানা বেশ জবরদস্ত ন্যাজওয়ালা লন্ঠনঘুড়ি কিনে দেওয়ার বায়না থাকতো বাড়ির বড়দের কাছে। মেয়ে বলে বিশেষ পাত্তা পাওয়া যেত না ঠিকই কিন্তু গোঁত্তা মেরে ঠিকই ঢুকে যেতাম দাদা ভাইদের দলে। বড় হয়ে জেনেছি ঘুড়ি ওড়ানো শুধুমাত্র বাঙালি কালচার নয়, সারা দেশ এমনকি বিদেশ জুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঘুড়ি ওড়ানোর চল সেই কবে থেকে হয়ে আসছে। মকরসংক্রান্তিতেও একইভাবে দিনটি উদযাপন হয় ঘুড়ি ওড়ানোর মধ্য দিয়ে। শৈশব তো এক আশ্চর্য রূপকথা, সে কমবেশি সবার জীবনেই, ফুটপাতে কাগজ কুড়িয়ে বেড়ায় যে নিরন্ন বালক পিঠে একখানা চটের বস্তা নিয়ে, তাকেও দেখেছি বিপন্ন শৈশবে একখানা কাটা ঘুড়ির পেছনে দৌড়ে যেতে। এই বয়েসের গায়ে লেগে থাকে বিভ্রম, এক অচিন দেশের স্বপ্ন ভাসে চোখে, রাক্ষস-খোক্কসের গল্প শেষ করে সদ্য পা পড়েছে রহস্য-রোমাঞ্চের উঠোনে, ফেয়ারি টেলসের র‍্যাপুনজেল বাড়িয়ে দিয়েছে কেশভার, ক্ষীরের পুতুলের ছেলেমানুষি কমে আসছে, দক্ষিনারঞ্জন মিত্রমজুমদার কবে বন্ধ করেছেন 'ঠাকুরমার ঝুলি', বয়:সন্ধি হাতছানি দিচ্ছে হ্যারি-পটারের রাজ্যে ! তার ভেতর একখানা নির্মল দিনের আহ্বান, ঘুড়ি বাড়িয়ে কেটে দিতে হবে প্রতিপক্ষের ঘুড়ি, হালকা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে সেইসব হলুদ- গোলাপি - নীল মুহুর্তেরা চলে যাচ্ছে ঘরবাড়ির মাথার ওপর দিয়ে, মাঠ পেরিয়ে, পুকুর নদী, ইস্কুল-পাঠশালা, দু:খ-যন্ত্রণা, পেরিয়ে এক অদ্ভুত আলোবাতাস আর রোদ-চাঁদের দেশে! সেখানে সহজ আনন্দ, অবিমিশ্র সুখ—ঠিক ওখানেই উড়ে যেতে চেয়েছিলাম ঘুড়ি হয়ে আমরা সবাই সেই সত্য দ্বাপর থেকে এই এক্স- ওয়াই জেনারেশন অবধি। মনে মনে। কিন্তু পেরেছি কি? এক দু'বার পিছুটান টেনে রেখেছে মাটির দিকে তারপর সামান্য ডিগবাজি খেয়ে সাঁ সাঁ উড়ে গেছি, তখন আমাদের কৈশোরের শেষবেলা, উদ্ধত যৌবন ছুঁয়ে যাচ্ছে আলতো করে! গ্রামীণ জীবনে বৈচিত্র‍্য থাকে না, চাকচিক্য থাকে না কিন্তু একটা ভীষণ মায়া জড়িয়ে থাকে যাপনে, সময়ে সময়ে সে মুহুর্তের আয়নার সামনে সেরে নেয় প্রসাধন, সামান্য টিপ-কাজলের ম্যাজিক মোমেন্টস। খড়কে ডুরে শাড়ি যেমন পোলকা ডটের ফ্রক-পড়া কিশোরীকে এক ঝটকায় বউ বউ করে দেয়, তেমনই। ঘুড়ি ওড়ানোর উন্মাদনায় সারাটাদুপুর কেটে যেত এক অমলিন গিন্নীপনায়। স্বল্প সামর্থ্যের সামান্য আয়োজনের আনন্দ যে অনুষঙ্গের সান্নিধ্যে এমন রঙিন হয়ে ওঠে তার সাক্ষী থাকতো পাড়াগাঁর দুপুর, ডাহুক ডাকা নি:স্তব্ধতা, আমাদের শালিক-শালিক আড়ি-ভাব আর একটা আস্ত টমবয়িশ ছেলেবেলা ! মফস্বলি অভ্যাসে থিতিয়ে আসছে জীবন কিন্তু থিতু হতে পারিনি। বেড়ে রেখেছিলাম ঘুড়ি, ভেবেছিলাম হেভি মাঞ্জা দিয়েছি সুতোয়, ঠিক কেটে যাবে ওদিকের চাঁদিয়াল। হয়নি। কারোরই হয় না। শুধু কাটাকুটি করতে গিয়ে মিথ্যেমিথ্যি নষ্ট করে ফেললাম এতগুলো বছর। আমরা আকাশে উড়তে চেয়ে বারবার আছড়ে পড়েছি মাটিতে, এখন মাটি কামড়ে টিকে আছি। ভারি ট্যাক্স আদায় করছে সময়। ইচ্ছেঘুড়ির সুতোয় টান দিয়েও ফেরাতে পারিনি। তারা এমনি হেসে ভেসে গেছে। আমরা ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে উড়িয়ে দিয়েছি আমাদের যাবতীয় ভালোবাসা। তোমার ভালোবাসা ও কি কেটে গেল? ভো- কাট্টা ...আজও, ক্ষয়ে আসা বিকালে শুনলে বুকের ভেতর কেমন করে! চোখে কম দেখি, আকাশের দিকেও তাকালে চোখের সামনে কত কী সব কাটাকুটি, রুপোলি তারের সর্পিল গতি। চোখ কুঁচকে দেখতে পাই ওই দূরে উড়ছে একখানা ফিকে হলুদ রঙা ঘুড়ি, চকমিলানো দোতলার বারান্দায় সিমেন্টের জাফরির ফাঁক দিয়ে বাড়িয়ে আছি পা, বসে বসে লাটাইয়ে সুতো ছাড়ছি, সারাদুপুর খচ -খচাৎ! ইলেকট্রিক পোলে ঝুলে থাকতো একটা নীল ঘুড়ি সারাটা শীতকাল। সেইদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অঙ্কে ভুল হতো। দৌড়ে চলে যাওয়া যায় না আরেকবার! ওই তো সামনের বাড়ির ছাদে হুটোপুটি করছে মানা, অন্তু, ভেন্টুলরা। হাঁসের ডিমের লাল লাল ঝোল আর দুগ্গাছাতু ভাজা! বিকেলে কেষ্টর দোকানের লঙ্কাকুচি দেওয়া মচমচে ফুলুরি। আর হয় না হে ! দুপুরের কাটা ঘুড়ি ঘাড় গুঁজে পড়ে আছে সন্ধে নেমে আসা মহানিমের উঁচু ডালে, বিজ্ঞাপনের আলোতে মনে হচ্ছে যেন একটা প্রকান্ড বাদুড় ঝুলে আছে। ফুরফুরে রোমান্টিসিজম বদলে গেছে সংশয়ে। দৌড়ে ফিরি টলটলে ভয়ের ত্রিসীমানা ছেড়ে নিশ্চিত আরামের ঘোলা জলে। আমরা সব্বাই তো দৌড়েছি নিরন্তর, ফ্রি-প্রাইমারি স্কুলের সেই অনন্ত মাঠ কখন একমুঠো হয়ে ঢুকে পড়লো একটা আটশ' স্কোয়ারফিটের অপ্রশস্ত ছাদে, চারদিকে ইমারতের আকাশ ছোঁয়ার আভিজাত্যের মাঝে এখন উঁকি মেরে দেখতে হয় দিগন্তের দিকে ভেসে যাওয়া একখানা ভো-কাট্টা ঘুড়ি, ভাঙা লাটাইয়ের মত নড়বড়ে হয়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে আমাদের ধুলোমাখা দিন ! আমরা কাটি পতঙ্গ ! ভো-কাট্টা তোমার ভালোবাসা..
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register