Sat 25 October 2025
Cluster Coding Blog

T3 || আমার উমা || 26য় রুচিরা মুখোপাধ্যায় দাস

maro news
T3 || আমার উমা || 26য় রুচিরা মুখোপাধ্যায় দাস

রেসপনসিবিলিটি

মনের মধ্যে জমাট করা মেঘ আর একরাশ দুশ্চিন্তাকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বেরোলো সুধা। আজ কাজে তাকে যেতেই হবে। পরপর পাঁচ দিন কামাই করেছে সে। আজ না গেলে কাজ তার আর থাকবে না হয়তো। এখন যে কোন কাজেই প্রতিযোগিতার খেলা। একবার কাজ চলে গেলে নতুন করে কাজ জোগাড় করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার কথা ভাবলেই সুধার বুকটা কেঁপে ওঠে। তাছাড়া মাস গেলে অতগুলো করে টাকা পায়। এর বেশি কামাই করলে মাইনে থেকে টাকাও কাটা যেতে পারে। আট বছরের অসুস্থ ছেলে সোমুকে একা বাড়িতে রেখে কাজে বেরোতে সে আজ তাই বাধ্য। কী জানি কেমন থাকবে ছেলেটা! কাল রাত থেকে জ্বরটা আর আসেনি। খাটে উঠেও বসেছে। যদিও এখনো বেশ দুর্বল। কোন অসুবিধা হলে পাশের সুনীলের দোকান থেকে সোমু যেন সুধাকে ফোন করে। সুধাও মাঝে একবার সুনীলের দোকানে ফোন করে সোমুর খবর নিয়ে নেবে। ঘরে ভাত ডাল ফুটিয়ে রেখে এসেছে। সাথে ডিম সেদ্ধ। ডিম খেতে সোমু খুব ভালোবাসে। যদিও কদিনের জ্বরে মুখে তার অরুচি! তবুও...! বৌদিমণিকে বলে দুপুরে একবার বাড়ি এসে ছেলেকে নিজে হতে খাইয়ে দেবে। এমনই ইচ্ছে তার। ভাবতে ভাবতে অর্ধেক রাস্তায় এসে হঠাৎ সুধা দেখল সে মোবাইলটা বাড়িতে ফেলে এসেছে। আবার পথ ঘুরে বাড়ির দিকে পা বাড়াল সে। মোবাইল ছাড়া অসুস্থ সোমুর খবর নেবে কী করে! মোবাইলটা আজ তার তাই খুবই জরুরী। সোমু অসুস্থ বলে আজ দরজাটা ভেজিয়ে রেখেই বেরিয়েছিল সুধা। যাতে প্রয়োজনে আস পাশের লোক তাকে সাহায্য করতে পারে। ভেজান দরজাটা আঙুলের স্পর্শে অল্প ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ঘরে ঢুকে সুধা দেখল খাটের একপাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে সোমু ঘুমিয়ে পড়েছে! এই তো একটু আগেই সোমু জেগে ছিল! বসে বসে টিভি দেখছিল। তবে কি আবার জ্বরটা ঘুরে এল! গায়ে হাত দিয়ে সুধা দেখল গা গরম। তাড়াতাড়ি থার্মোমিটার নিয়ে এসে সোমুর টেম্পারেচার নিল। আবার একশ! এখনই ওষুধ খাওয়ানো দরকার। না হলে হুরহুর করে জ্বর বেড়ে যেতে পারে। গ্লাসে জল ঢেলে একটা ওষুধ বের করে ঘুমন্ত সোমুকে ডেকে ওষুধটা খাইয়ে দিয়ে বলল, - " এই কোটোতে মুড়ি আছে। একটু খেয়ে নে। খালি পেটে ওষুধ খেলে যদি..." সুধার কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে পাশের ঘরের সন্ধ্যার ছেলে বলে উঠলো, - "কাকি তুমি আজ কাজে যাবা?" - " হ্যাঁ... আমি তো বেরিয়েই গিসলাম। মোবাইলটা ভুলে ফেলে গিছি বলে অর্ধেক রাস্তা গিয়ে আবার ফিরে এলাম। ভাগ্যিস এসছিলাম। নইলে আমার সোমু...!" - " তুমি ভেবো না কাকি। আমি আজ ইসকুলি যাবনা। বাড়িই থাকপো। আমি মাঝে মাঝে উঁকি দে সোমুকে দেখি যাব ক্ষুনি।" ছল ছল চোখে সুধা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ছোট্ট অসুস্থ সোমুর দিকে! দুই - " আজকের প্রোগ্রামটা ক্যান্সেল করলে কি এমন ক্ষতি হতো তিস্তা?" - " হাজার হাজার লোক টিকিট কেটে বসে আছে। আমি এডভান্স নিয়ে রেখেছি। এবার তুমিই বলো কি ক্ষতি হতো আর হতো না।" বেশ গম্ভীরভাবে বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো তিস্তা। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর তিস্তা আবার বলে উঠল, - " তুমিও তো আজকের দিনটা অফ করতে পারতে অনিকেত! বাবার দায়িত্বটা নিশ্চয়ই শুধু আমার একার নয়! তাছাড়া লাস্ট ফাইভ ডেস আমি তো কোন প্রোগ্রাম রাখিনি! সুধা ছুটিতে আছে বলে..." গম্ভীরভাবে বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে অনিকেত বলল, " আজকের মিটিংটা মোস্ট ইম্পর্টেন্ট। আর আমি হলাম লিডার। আমি না থাকলে মিটিংটা ক্যান্সেল হয়ে যাবে। আর ক্যান্সেল হলে অনেকগুলো টাকা আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। পুরো রেসপনসিবিলিটি আমার উপর। না হলে..." - "যত নষ্টের গোড়া হল সুধা। কি এক ছেলের জ্বর ফর বলে পাঁচ পাঁচটা দিন এলো না। আজ আসবে বলল। তাও দেখো, মহারানীর এখনো দেখা নেই।" বেশ বিরক্ত হয়ে বলল তিস্তা। তারপর মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলল, - " দাঁড়াও, আমি সুধাকে একটা কল করে দেখি তো! আজও কি ডুব মারবে!" - " বাড়ির বউ হিসেবে তোমারও তো কিছু দায়িত্ব থাকে তিস্তা! সবটা কাজের লোকের ওপর ভরসা করলে কি সংসার চলে?" - " মানে? যত দায়িত্ব বাড়ির বউয়ের! ছেলের দায়িত্ব নেই? বাবার ওপর! তোমাদের প্রবলেমটা কি জানো তো, তোমরা শুধু নিজের কাজটাকেই ইম্পর্টেন্ট বলে মনে করো! " অনিকেতের বাবা বৃদ্ধ অসুস্থ হেমেন্দ্র বাবুকে নিয়ে তিস্তা আর অনিকেতের মধ্যে লেগে গেল তুমুল ঝগড়া। অসুস্থ হেমেন্দ্র বাবু বিছানায় শুয়ে শুয়ে সবই শুনছেন। আর দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখার অপরাধে মনে মনে ভগবানকে দোষারোপ করছেন। জল তেষ্টায় বুকটা তার ফেটে যাচ্ছে। তবুও চিৎকার করে জল চাইতে সংকোচ বোধ করছেন। রান্নাঘরে সাবিত্রী আর বলাই কাজে ব্যস্ত। সাবিত্রী বাসন মাজা, ঘর মোছার ঠিকে লোক। আর বলাই রান্নার লোক। তিস্তা- অনিকেতের ঝগড়ার সুর তাদের কানেও ভেসে আসছে। বাসন মাজতে মাজতে সাবিত্রী হঠাৎ বলে উঠলো, - " মেয়েছেলের এত গলা কী ভালো! বৌদিমণি চেল্লাচ্ছে দ্যাখো! দাদা তো ঠিকই বলেছে, বাড়ির বউ অনেক দ্যাখশুনি চলতি হয়।" রান্নার খুন্তিটা নাড়তে নাড়তে বলাই বলে উঠলো, - " ওই জন্যুই তো আমি আমার বউরে কাজে বেরুতি দেইনি। তুই ঘর সামলা। বাইরে থেকি যা রোজগার আমি করে আনবো তাতে যা চলার চলবে। সব দায়িত্ব কি আর একসাথি নেওয়া যায়! ঘরে বাইরি! বৌদিমণি যাবে কোন দিকি!" হঠাৎ বেজে উঠল ডোরবেল। ডোর বেল শুনে চটজলদি সদর দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল তিস্তা। সুধাকে দেখে যেন সে হাফ ছেড়ে বাঁচল। মাথাটা বেশ গরমই ছিল। খুব রেগে সে সুধাকে বলে উঠলো, -" মহারানীর সময় হল আসার! পরপর পাঁচ দিন আসিস নি। কোথায় আজ সকাল সকাল চলে আসবি তা না...!" মাথা নিচু করে থেকে সুধা বলল, - " একটা কথা ছিল বৌদিমণি!" - " আবার কি কথা? আবার ছুটি নিলে কাজ ছেড়ে দে। আমি অন্য লোক দেখে নেব।" ঝাঁঝিয়ে বলে উঠলো তিস্তা। সুধা ঠান্ডা স্বভাবের। সে শান্ত ভাবে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, - " আমার ছেলেটার খুব জ্বর বৌদিমণি! আজ দুপুরে একবার বাড়ি যাবো। ছেলেটারে খাওয়াতে।" তিস্তা বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে বলল, - " তোদের বাহানার আর শেষ নেই সুধা। যা কাপড় ছেড়ে বাবাকে তুলে বসা। বিছানা ঝার। বাসি বিছানা পড়ে আছে বেলা দুপুর অবদি। আমি আর তোর দাদা এখনই বেরিয়ে যাব। বাবাকে স্নান করিয়ে খাইয়ে তারপর বাড়ি যাবি। আর হ্যাঁ, দুপুরে বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার ডুব মারিস না কিন্তু। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে আসবি। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা ডিউটি তোর। অলরেডি দশটা বেজে গেছে মনে রাখিস। প্রত্যেকটা কাজের একটা রেসপনসিবিলিটি থাকে জানবি।" মাথা নিচু করে সুধা ঘরে ঢুকলো। তিস্তা আর অনিকেত বেরিয়ে গেল যে যার কাজে। অসুস্থ বৃদ্ধ হেমেন্দ্রবাবুকে সুধা উঠে বসালো। হেমেন্দ্রবাবু কোনো রকমে কষ্ট করে উঠে বসে বললেন, -" আমায় একটু জল দে তো সুধা। বড় তেষ্টা পেয়েছে।" সুধা গ্লাসে জল ঢেলে দিল। হেমেন্দ্রবাবু কাঁপা কাঁপা হাতে জলের গ্লাসটা ধরে জল খেয়ে বললেন, - " ওষুধের বাক্সটা দে তো সুধা। ওষুধটা খাই।" রোজ সকালে সুধাই ওষুধটা খাইয়ে দেয়। আজ এখনো ওষুধ খাওয়া হয়নি দেখে সুধা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, " সকালের ওষুধটা এখনও খাউনি?" মুচকি হেসে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেমেন্দ্র বাবু বললেন, - " রেসপনসিবিলিটি শব্দটা যে বিক্রি হয়ে গেছে সুধা!"
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register