Mon 27 October 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক রম্য সাহিত্যে ইন্দ্রাণী ঘোষ (অন্তিম পর্ব)

maro news
সাপ্তাহিক রম্য সাহিত্যে ইন্দ্রাণী ঘোষ (অন্তিম পর্ব)

অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে 

পুনা শহর সেই ষাট, সত্তর দশকে ঘুমন্ত শহর থাকলেও সংস্কৃতিচর্চার কোন অভাব ছিল না । সেই সময় মারাঠি নাট্যমঞ্চে একের পর এক কালজয়ী নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে । পরপারের রঙ্গমঞ্চেও কোন অচেনা নাট্যকারের নির্দেশনায় অচেনা, না বোঝার, না ছুঁতে পারার নাটকেরা ঘটে গেছে নিজের মত করে এই শহরের বুকে । একই সঙ্গে ঘটে চলেছিল পুনার আজকের 'এডুকেশনাল হাব' হয়ে ওঠার প্রস্তুতি । কি অসম্ভব বর্ণময় শহর এই পুনা সবদিক থেকে ভাবলে অবাক হতে হয় ।

এককালে পুনায় সাহেবদের ক্যান্টনমেন্ট ছিল । আমাদের দেশ সবসময়তেই সাহেবদের দেখানো পথে চলেছে গুটি গুটি পায়ে এ কথা অনস্বীকার্য । তা সাহেবদের দেশে বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য সব রকম সু্যোগ, সুবিধে করে দেওয়া হয়., সেরকমই পুনার খারকি রোডে যুদ্ধে জখম সৈন্যদের জন্য "প্যারাপ্লেজিক রিহেবিলিটেশন সেন্টার ' ছিল, আজও আছে । যুদ্ধে পঙ্গু হয়ে যাওয়া সৈনিকদের সেখানে নতুন ভাবে বাঁচার দিশা দেখানো হয় । শোনা যায় কোন এক সৈনিক সেখানে মারা যান । সেই সৈনিকের স্ত্রী তাঁর সাথে রোজ দেখা করতে আসতেন এমনকি তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পরেও তিনি সেখানে আসতেন নানান কাজে । কালের নিয়মে এই ভদ্রমহিলাও মারা যান । ভদ্রমহিলার মৃত্যুর পরে অনেক সৈনিক এক নারী মূর্তিকে ওই সেন্টারের জানলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে, বাইরে বেড়িয়ে খুঁজলে আর কাউকে দেখতে পায় নি তাঁরা । হয়তো আহত মানুষগুলোকে নতুন করে বাঁচতে দেখতে তাঁর ভালো লাগত, নিজের মৃত্যুর পরেও সেই ভালো লাগা ছিল। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা যে বড় সুন্দর ।

পুনার ডিং রোডে গভীর রাতে দেখা যেত এক মুন্ডুবিহীন আরোহীকে । শোনা যায় কোন এক মিলিটারী ট্রাক বিশাল বিশাল স্টীলের পাত নিয়ে যাবার সময় হঠাৎ করে ব্রেক কষে । পিছনে আসা বাইকের আরোহীটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রাকটিকে ধাক্কা মারে এবং ওই স্টিলের পাতে তাঁর মাথাটি কেটে বেড়িয়ে যায় । গভীর রাতে ওই রাস্তায় তাঁকে দেখা যেত । বাইক চালিয়ে চলেছে এক হতভাগ্য মুন্ডুহীন আরোহী । আরেকটি ঘটনা বলি যা বিখ্যাত টেলিভিসন প্রেজেন্টার তবসসুম তাঁর জনপ্রিয় অনুষ্ঠান 'ফুল খিলে হ্যায় গুলসান, গুলসান' এ উল্লেখ করেছিলেন । তবসসুম আমার মামাদের বন্ধু ছিলেন । ফার্গুসন কলেজের ক্যাম্পাসের ঘটনা । কোন এক বাঙালী বীর পুঙ্গবের শখ হয়েছিল রাতের শোতে কোন ছবি দেখতে যাওয়ার । তা বাকি বন্ধুরা রাজি না হওয়াতে তিনি একাই গেলেন । ফার্গুশন কলেজের গেটের কাছে এসে দেখেন এক চানাওয়ালা বসে আছে । তাঁর কাছ থেকে চানা কিনে পয়সা দিতে গিয়ে দেখেন, পয়সা নিতে হাত বাড়ানো হাতটির সামনেটায় শুধু হাড় ছিল । তবু সে হাত বাড়ানো হয়েছে পয়সা নেবার জন্য । প্রচন্ড ভয় পেয়ে সেই বঙ্গবীর এক চৌকিদারকে দেখতে পেয়ে, ছুটে তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে চানাওয়ালার ঘটনাটি বলেন । তখন সেই চৌকিদার তাঁর নিজের হাতটি বার করে দেখিয়ে বলে 'এয়সা হাত থা ক্যায়া?' বলাই বাহুল্য সে হাতের সামনেটাতেও শুধু হাড় ছিল । উত্তম কুমার অভিনীত 'বিকেলে ভোরের ফুল' ছবিতে এইরকম একটি ঘটনার দৃশ্য রয়েছে । রাস্কিন বন্ড তাঁর লেখাতে এই ঘটনার কথা বলেছেন । আরেকটা গল্প পুনাতে শুনেছিলাম । এক ভদ্রমহিলা ছোটদের ইস্কুল খুলেছিলেন পুনাতে একটা ঝিলের পারে । ছবির মত ইস্কুল । সামনে কেয়ারি করা ফুলের বাগান, বাগানে একটা ছোট্ট পরির মূর্তি, পেছনে দু, তিন কামড়ার ইস্কুল বাড়ী । একজনই দিদিমণি, ভদ্রমহিলা নিজে । উনি ওই ইস্কুলেই থাকতেন । একদিন ইস্কুল বসেছে, বাচ্চারা বাগানে বসে টিপিন খাচ্ছে ন্যাপকিন পেতে, এমন সময় গেট ঠেলে ঢুকে এলেন একজন সন্ন্যাসিনী, শুভ্র বসনা , সোনার মত গায়ের রঙ, মাথার স্কার্ফের নিচ থেকে বেড়িয়ে আছে সোনালী চুলের কুচি, গলায় ঝুলছে প্রভু যীশুর ক্রসের লকেট । সন্ন্যাসিনী এলেন দিদিমণির সাথে আলাপ করলেন, বাচ্চাদের সাথে বসে ক্যারোল গাইলেন তারপর ছুটি হলে বাচ্চারা চলে যেতে, দিদিমণি ভাবলেন এবার সন্ন্যাসিনীর কাছে বসে দুটো ধর্মের কাহিনী শুনি । বাচ্চাদের বিদায় দিয়ে ফিরে আসতে আসতে তিনি দেখলেন সন্ন্যাসিনী হেটে চলেছেন ফুলের বাগানে রাখা পরীর মূর্তির দিকে এবং আস্তে আস্তে তিনি ওই মূর্তির মধ্যে বিলীন হয়ে গেলেন । ভদ্রমহিলা ভেবেছিলেন মনের ভুল, তারপর তন্ন, তন্ন করে খুঁজেও আর কখনো ওই সন্ন্যাসিনীর খোঁজ পান নি । নিজের উইলে তিনি গল্পটা লিখে রেখে যান, ইস্কুলটি চার্চকে দিয়ে দেন পরে। পাড়ার চার্চেও খোঁজ নিয়েছিলেন উনি, চার্চের ফাদার ব্যাপারটা গোপন রাখতে বলেছিলেন এবং অভয় দিয়ে বলেছিলেন যে প্রায় একশো বছর আগে এক সন্ন্যাসিনী এসেছিলেন বটে এই দেশে, গরীব শিশুদের পড়াতেন, অসুখ করলে সেবা করতেন, প্রভু যীশুর গান শোনাতেন তারপর এক ভয়ংকর ওলাওঠায় শিশুদের সেবা করতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয় । হয়তো তিনিই এখনকার শিশুদের সাথে দেখা করে গেলেন । শিশুদের মাঝেই তো ভগবান থাকেন ।

আজকাল হিম হিম ভয় এসে জড়িয়ে ধরলে দুটো লাইন বলি শুধু । "ধবংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক '

ভয়ের মাঝে অভয় একমাত্র কবিতাই তো দিতে পারে ।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register