Sun 26 October 2025
Cluster Coding Blog

রম্য রচনায় অর্পিতা চ্যাটার্জী

maro news
রম্য রচনায় অর্পিতা চ্যাটার্জী

ভালবাসা কারে কয়?

বাইরে ঝম ঝম বৃষ্টি হচ্ছে। আর ভেতরে আধো অন্ধকারে গান বাজছে "যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে সে কথা আজি যেন বলা যায়--" কি জানি বাড়িতে আছি বলেই কিনা ঝমঝম বৃষ্টি হলেই জানলা খুলে দরজা খুলে বাইরের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি। অন্ধকারে বৃষ্টির আড়ালে সবটা যে দেখা যায় তা নয়। তবু দেখি। ঘরের লোকে বলে তোকে তোর শাশুড়ির রোগে পেয়েছে। কথাটা আগেও অনেকবার শুনেছি পাত্তা দিইনি। কতদিন আমি মাকে বলতাম এতো টানের কষ্ট পাও তাও বৃষ্টির ছাঁটে ভিজছ। মা শুনতে পেতনা এসব নাসূচক অবান্তর কথা। নিজের যা যা করার করত। শীতের মাঝ রাত ঝমঝম বৃষ্টি দরজা খোলার শব্দ শুনে আমি কতদিন উঠে বসেছি। দেখেছি মা চুপ করে আস্তে আস্তে চন্দ্রমল্লিকার ভারি ভারি টবগুলো টেনে টেনে ঘরে ঢোকাচ্ছে। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে মাকে সাহায‍্য করতাম। তারপর সব টব ঢোকানো হলে বারান্দায় বসে এক কাপ কফি খেয়ে আমি শুতে যেতাম ঘরে মা বারান্দায় বসে থাকত। সূর্যকে ডেকে তোলার মহান দায়িত্ব পালন করার জন‍্য। জানি শীতকাল নয় এখন তবু অসময়ের বৃষ্টি এলে জানলা খুলে দেখি দরজা খুলে দেখি গাছগুলোকে। কয়েকটা টব আছে খুব গোড়ায় জল জমে থাকে যে খেয়াল রাখতে হয় । জলটা না ফেলে দিলে গাছের গোড়াটা যে পচে উঠবে । ভয় করে। হস্টেলে থেকেছি ছোট থেকে বিয়ে করার একদিন আগে বাড়ি গেছিলাম তারপর বিয়ের পর থেকে গৃহী জীবনের টুকিটাকি সবই শিখেছি শাশুড়ি মায়ের কাছেই। মা খুব যত্ন করতেন বাগানের কোণে একটা কালো তুলসির গাছ ছিল সেটার। আমার নাচের অনুষ্ঠান গালে ব্রণ মা কিছু তুলসি পাতা তুলে হাতে বেটে আমার গালে লাগিয়ে দিতেন। একথা সেকথায় খেয়াল করতাম ব্রণ উধাও। নাতনি হাঁচল মা ভোরবেলা একচামচ মধুতে তুলসি পাতা দিয়ে খাইয়ে দিতেন। হাঁচি বন্ধ। বাবা একটু কাশল মা কাল তুলসি মঞ্জরির চা বানিয়ে দিতেন। বাবার সে চা খেয়ে কাশি কমে যেত। কারণে অকারণে তুলসি পাতা তুলসির কাঠি তুলসির ফুল সবই মা খুব আগলে রাখতেন। মাকে কত ঠাট্টা করতাম এই তুলসি নিয়ে। গত একবছর ধরে আমাকেও খুব তুলসিতে পেয়েছে। না না মা যে কারণে তুলসি ভালোবাসতেন সে কারণে নয়। আমি তুলসি গাছটাকে ভালবাসি অন‍্য কারণে। আসলে কবির গীতাঞ্জলি আমরা যারা রোজ কারণে অকারণে পড়ি তারা একটু ভালোবাসা বাদী হয়ে উঠি মনে মনে। পরজীবী জীবনে ভালোবাসা জলের মত। ভালোবাসতে ভালোবাসা দিতে ভালোবাসা পেতে বা ভালোবাসা দেখতে বড় ভাল লাগে। মন ভাল হয়ে যায়। শুধু মানুষে নয় আমি পশুপাখি গাছপালার মধ‍্যেও সেসব নিবিড় ভালোবাসার ছায়া দেখতে পাই। আমার মেহগণি গাছের গায়ে জড়িয়ে আছে নীলমণিলতা। মেহগণির পাতায় যখন লালরঙ ধরে ফুরিয়ে যাবার সুর নীলমণি তখন তার সবটুকু ঢেলে নীল ফুলে ফুলে তাকে সাজিয়ে তোলে। ফুরোনোর কথা ভুলে মেহগণি তখন ভরে ওঠার নেশায় মত্ত । ঠিক তেমনি তেঁতুল গাছের গায়ে জড়িয়ে গোলমরিচ গাছটি যে ভারি এক নিবিড় সুখে বাঁচে সে আমি বেশ বুঝতে পারি তার পাতার বাহারে। আমার তুলসি গাছটারও এমন একটা সঙ্গী আছে। প্রাণের টান তাদের। তুলসি জানে সে অনেক বড় প্রাণ সে তাকে বেশীদিন আগলে রাখতে পারবেনা তার কাছে। তবু ভালোবাসে অফুরান ভালোবাসে। রাধা কৃষ্ণের কথা মনে পড়ে। কৃষ্ণ মথুরায় চলে যাবে জেনেও রাধা তার সবটুকু উজাড় করে দিতে কোনদিন দ্বিধা করেনি তুলসিও করেনা। সে চন্দন গাছটির গায়ে গা লাগিয়ে থাকে সে জানে চন্দন গাছটির পরিপূর্ণ হয়ে ওঠার জন‍্য এখন প্রতি মুহূর্তে তাকে তার প্রয়োজন তাকে তার দরকার। তুলসি এ কথা যেমন জানে চন্দনের এখন তাকে ছাড়া চলবে না এও তো সে জানে একদিন এই চন্দন গাছই সেই ঈশান কোণের আকাশের রাজত্বের ডাকে এই ভালোবাসার তুলসিকে সে নির্দ্বিধায় অস্বীকার করে চলে যাবে। বেড়ে উঠবে এক আকাশ সুখে। কত পাতা কত পাখি কত আলো ভিড় করবে তারমনের দরজায়। দরজা ফাঁক করে ওদের দেখি। দেখি ওদের টবের গোড়ায় জল জমেছে। জলটা ফেলে চুপ করে বসে গান শুনি আর ভাবি - ভালোবাসা কারে কয়? ছেড়ে দেওয়াকে না ধরে রাখাকে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register