Tue 04 November 2025
Cluster Coding Blog

T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || 26য় শর্মিষ্ঠা সেন

maro news
T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || 26য় শর্মিষ্ঠা সেন

নিঝুম দুপুর

  ঠিক সাড়ে তিনটেয় বাস থেকে নেমে ঝিনুক প্রথমে বুলুপিসিদের বাড়িতে ঢুকলো৷ নবপল্লীর মোড়ে নেমে একটু এগিয়ে ডানদিকে ঘুরলেই প্রথম বাড়িটা বুলুপিসিদের৷ ঝিনুকদের তার পরের বাড়িটা৷ সাদা রং এর ছোট্ট দোতলা বাড়ি৷ খয়েরী গেট৷ গেটের ওপর আর্চ বেয়ে মাধবীলতার ঝাড়৷ সারা বছর কমবেশী ফুল দেয় গাছটা৷ ঝিনুক বুলুপিসির বাড়ি যাবে চাবি আনতে৷ মা বাবা দুজনেই অফিসে আর ঠাকুমা ফুলমণিকে সঙ্গে নিয়ে দেশের বাড়ি মালদা গেছেন, তাই আপাতত এই ব্যাবস্থা ৷ বুলুপিসিদের বেল টা বাজাতেই সুইটুর আওয়াজ পেল ঝিনুক৷ সুইটু ওদের কুকুরের নাম৷ সাদা রং এর স্পিৎজ্ ,ঝোলা ঝোলা লোমওয়ালা৷ খুব বিচ্ছু ৷ কুকুর না কাঠবেড়িলী কে জানে! সারাদিন দৌড়ঝাঁপ৷ ওরা বলে সুইটু একদম মানুষের মতো, সব বোঝে! আনন্দ পায়, দুঃখ পায় , অনিয়মে অসুখ করে , খাওয়া দাওয়াও মানুষের মতো৷ ডগফুড নয় , সুইটু মাংস ভাত খেতে অভ্যস্ত৷ রোজ আলাদা রান্না হয় তার জন্য ৷ শুধু কথাটাই যা বলতে পারেনা৷ ঝিনুক কুকুর বেড়াল পশু পাখী একদম পছন্দ করেনা৷ সে জানে কুকুর আঁচড় দিলেও ইঞ্জেকশন নিতে হয় , আর বুলুপিসিদের বাড়ির কুকুরটা সবসময় ঝিনুকের গায়ে লাফিয়ে উঠতে চায়৷ আজও দরজাটা খুলতেই ঝাঁপিয়ে আসতে চাইল সুইটু , ঝিনুক চট করে সরে দাঁড়াল একপাশে৷ বুলুপিসির মা বলেন, 'ওরে তোকে ভালবাসে বলে অমন করে, খেলতে চায় !' হুহ্ ! ভালবাসা না ছাই! ঝিনুককে এমনিতেই অনেক লোক ভালবাসে, আর ভালবাসার দরকার নেই! ঝিনুক দিদার থেকে চাবির থোকা নিয়ে একদৌড়ে বাড়িতে ঢুকে যায়৷ ফ্রেশ হয়ে একা একাই খাবার বেড়ে খেয়ে নেয়৷ খাবার মা সকালে জলসরা করে রেখে গেছে ৷ জলসরা মানে খাবারের পাত্রগুলো জলের মধ্যে বসানো থাকে যাতে নষ্ট না হয়৷ এখন ফুলমণি নেই, মা অনেক সকালে রান্না করে অফিস যায়৷ মায়ের অফিস নরেন্দ্রপুর৷ দক্ষিণ কলকাতায়৷ বাসে অনেকটা সময় লাগে৷ বাবার বরং কাছে ৷ বাবা ঝিনুককে আটটায় বাসে তুলে বাড়ি ফিরে স্নান খাওয়া দাওয়া করে বেরোয়৷ বাবাকে অবশ্য সবদিন অফিস যেতে হয়না৷ ওদের 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' করা যায়। যখন ক্লায়েন্টের সাইট ভিজিট থাকে বা মিটিং থাকে তখন গেলেই হলো৷ বাবা বাড়িতে থাকলে সারাদিন ল্যাপটপ খুলে টুকুর টুকুর করে খোপ কেটে তাতে লেখে আর রং ভরে৷ আর কাজ না থাকলে পড়াশুনো করে৷ ঝিনুক ঠিক করে নিয়েছে ও বড় হয়ে চাকরী করবে না৷ ও বরং ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খুলবে৷ তাতে শুধু টয়েজ আর কমিক বুকস থাকবে৷ ঝিনুকের এবার ক্লাস সিক্স৷ এখন অনেক বড় হয়েছে৷ বুঝতে শিখেছে৷ মা বাবার মতো এত এত পড়াশুনো করে শেষ মেষ সেই খাটুনি করা ঝিনুকের পক্ষে সম্ভব নয় বরং বুলুপিসির জব অনেক ভাল৷ বুলুপিসি কলেজে পড়ায় আর মাঝে মাঝেই দেশে বিদেশে পেপার পড়তে যায়৷ সেভাবে দেখতে গেলে এ পাড়ায় ঝিনুকের একমাত্র বন্ধু বুলুপিসি। বাকীরা যারা আছে যেমন সামনের বাড়ির পপিদি, ক্লাস এইট আর দুটো বাড়ি পরে সম্বুদ্ধদা, ক্লাস নাইন ,ওরা ঝিনুককে খুব হেয় করে৷ সবাই গল্প করলেও ঝিনুককে মোটেও কাছে ডাকে না, গম্ভীর হয়ে বলে , "খুকী, এখন নয়, আমরা বড়োরা কথা বলছি৷" কই বুলুপিসিতো এমন বলে না! বুলুপিসি যেমন ঝিনুকের বন্ধু তেমন মায়েরও বন্ধু৷ আর প্লাস পয়েন্ট হল বুলুপিসির কাছে হ্যারি পটারের সবকটা বই আছে৷ প্রথম দুটো পড়া হয়ে গেছে৷ সেভেন এ উঠলে তিন নম্বর বইটা পড়তে দেবে বলেছে৷   খাবার খেয়ে, প্লেট সিঙ্কে নামিয়ে এসব নানান কথা ঝিনুক ভাবে খাটে শুয়ে৷ জানালার পর্দাটা সরানো৷ কী সুন্দর সাদা মেঘ ভেসে যায়! ভালো করে দেখলে বোঝা যায় সাদাটা আসলে ধবধবে সাদা নয়, অনেক শেডের সাদা৷ একটু গ্রে মেশানো, একটু ব্লু মেশানো, একটু ইয়োলো মেশানো সাদা৷ অনেকটা ঠাম্মার গায়ের সাদা পশমিনাটার মতো, সাদার ওপর হালকা হালকা কাজ , গতবার সিমলা থেকে কেনা হয়েছিল৷ ঠাম্মা থাকলে এতক্ষণে সব পর্দা টেনে ঘর অন্ধকার করে জোর করে ঝিনুককে ঘুম পাড়াতো৷ অবশ্য ঠাম্মার দোষ নেই৷ এসব হয় মায়ের জন্য৷ মায়ের ধারনা, ঝিনুক সময়ের মূল্য বোঝেনা৷ তাই সব ঘড়ি ধরে৷ টিভি দেখাও সেই রবিবারে৷ শনিবার যে গান থাকে৷ সকাল থেকে রেওয়াজ করতে হয়৷ অবশ্য ঝিনুক টিভি দেখতে পছন্দও করেনা৷ বুলুপিসির ছুটি থাকলে দুজনে মিলে ল্যাপটপে সিনেমা দ্যাখে, গান শোনে এবং গলা ছেড়ে গানও করে৷ ওবাড়িতে অনেক বেশী আনন্দ৷ এ বাড়িতে শুধু শাসন আর নিয়ম৷ এখানে জোরে কথা বলা যায় না৷ বাবা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করলে তো হয়েই গেল৷ তখন গোটা বাড়িটাকেই প্রিন্সিপ্যাল ম্যামএর অফিস মনে হয়!   ঠাম্মা আসবে সামনের সপ্তাহে ৷ দেশের বাড়িতে জেঠু থাকে ,বড়মা থাকে আর থাকে পলাশ দাদা ৷ সে বাড়িতে অনেক বড় বড় গাছ আছে। আম, লিচু, কাঁঠাল ,সুপুরি এসব৷ সবসময় কেমন ছায়া ছায়া অন্ধকার৷ সবসময় পাখীর কিচ কিচ, চ্যাঁ চ্যাঁ ,একদম মিষ্ট্রি স্টোরিগুলোর মতো৷ কে জানে ঠাম্মা এখন কী করছে! খুব গল্প করছে হয়তো! ওরা কী আর ঝিনুকের কথা ভাবছে? একবারও কী বলছে, আমাদের সোনামণিটা কেমন তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল! বড়মা নিশ্চয় এবারও টক মিষ্টি আমের আচার পাঠাবে, আমসত্ত্ব পাঠাবে৷ ঝিনুক রোজ দুপুরে শুয়ে শুয়ে আমসত্ত্ব গালে পুরে ঠাম্মার সাথে গল্পটল্প করবে৷ বাবা আসবে পাঁচটায়৷ মা ফোন করে সব হোমওয়ার্ক করে ফেলতে বলেছে৷ আচ্ছা, মা তো বলতে পারতো, "ঝিনুক, তোমার মন খারাপ করছে না তো? ঠিক আছে, আজ পড়তে হবে না, তুমি গান শোনো৷ আমি আইসক্রীম আনবো৷" যদিও ঝিনুকের মন খারাপ করছে না, তবুও, মা আদর করলে কত্ত ভালো লাগে! মা এখন শুধু বলে, "ঝিনুক যথেষ্ট বড় হয়েছ , এভাবে সময় নষ্ট কোরোনা! ঝিনুক ফল খেয়ে নাও! ঝিনুক, বই গুছিয়ে রাখনি কেন?" বড়রা কেউ জানেনা , ঝিনুক চুপচাপ শুয়ে অনেক কিছু ভাবে৷ যদি স্পাইডারম্যান আর সুপারম্যানের দেখা হয় কখনও কী হবে? যদি হলিউডে প্রফেসর শঙ্কুকে নিয়ে স্পিলবার্গ মুভি বানান তাহলে কে প্রফেসর শঙ্কু হবে? বড় হয়ে যদি ঝিনুক একজন সুপার পাওয়ারফুল কমিক ক্যারেকটার তৈরী করে তাহলে সে ম্যান হবে না উওম্যান? ঝিনুকের নিজের পছন্দ উওম্যান ৷ বুলুপিসির মতো ৷ তবে এখন ওবাড়িতে সবাই সুইটুকে নিয়ে মেতে থাকে ৷ ঠাম্মা বলে, দাদু দিদাকে ব্যস্ত রাখার জন্য এই ব্যাবস্থা৷ হবেও বা৷ আগে বুলুপিসি কোথাও গেলে ওদের বাড়ি থেকে কোনো আওয়াজ পাওয়া যেতনা, এখন সবসময় হইচই, সুইটুর ভৌক্ ভৌক্৷ ও বাড়ির দাদু রোজ পার্কে যায়, মাঝেমাঝে ঝিনুকও থাকে, যেদিন ঠাম্মা হাঁটতে বেরোয়, সেই দিনগুলোয় ৷ আচ্ছা, ঝিনুক কি অঙ্ক গুলো করে নেবে? না আর একটু শোবে? চারটে বেজে গেছে৷ একটু আগেই ঘড়ি শব্দ করে বলেছে ৷ ঘড়িটা ঘন্টায় ঘন্টায় বাজে ৷ রাত্তিরে আলো নেভালে ঘড়িও ঘুমিয়ে পড়ে৷ কি ভালো না ? অবশ্য ঝিনুকের বেশী পছন্দ জেঠুর বাড়ির পেন্ডুলাম দোলা ঘড়ি৷ সেটা চব্বিশঘন্টাই ঢং ঢং করে আওয়াজ করে৷ মা বলে ও বাড়ি গেলে প্যাঁচার মতো জেগে থাকতে হয় সারারাত৷ মায়ের ঘুম খুব পাতলা৷ ঝিনুকের দুধের গ্লাসে যেমন সর পড়ে, তেমন৷ ঝিনুকের তো ঘন্টা গুনতে গুনতেই ঘুম এসে যায়৷ কেমন নৌকোয় চড়ে হালকা দুলুনির মতো৷ সেই যে একবার মায়াপুরে যাওয়া হয়েছিল, নবদ্বীপ থেকে নৌকো চড়ে, তেমন৷ নবদ্বীপে ঠাম্মার বাপের বাড়ি৷ ঝিনুককে সবাই খুব আদর করেছিল৷ ঝিনুক তখন অনেক ছোট৷ মন্দিরে ঢোকার আগে লাল টুকটুকে জুতো খুলতে হয়েছিল বলে ঝিনুক প্রবল আপত্তি করেছিল এটা শুধু মনে আছে৷ আর কী যেন হয়েছিল! ঝিনুক কোলে কোলেই ঘুরেছিল৷ এখন আর কেউ কোলে তোলে না৷ ঝিনুক যে বড় হয়ে গেছে!মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মায়ের কোলে উঠতে৷ মায়ের শ্যাম্পুর গন্ধটা এত ভালো যে নাকে এলেই আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসে, কি কমফোর্টিং! —"এই যে , ঝিনিঝিনি ঝিনুকমালা...উঠে পড়ো৷" ঝিনুক শুনতে পেল কে যেন অনেক দুর থেকে ডাকছে৷ মাথায়,কপালে ঠান্ডা ঠান্ডা আঙুলের ছোঁয়া৷ ঝিনুক চোখ খুলে দেখল রোদ পড়ে গেছে কখন! মা পাশে বসে৷ হালকা হলুদ হাউজকোট গায়ে, তারমানে গা ধোয়াও হয়ে গেছে৷ —"মা, তুমি কখন এলে?" — "অনেকক্ষণ, বাবাও এসে গেছে৷ ঝিনিসোনা একা একা কী করছে দেখতে চলে এলাম৷" —"মা, একটু পাশে শোবে? আর দু মিনিট ঘুমোই?" —"না,না, এবার উঠে পড় , রাতে ঘুম আসবেনা " বলেও মা ঝিনুকের পাশে একটু শুয়ে পড়েন৷ ঝিনুক মায়ের শরীরে ঢুকে গিয়ে মা কে আঁকড়ে ধরে৷ আসলে ঝিনুক বড় হতেই চায়না৷ ছোট থাকাই সুখের৷ পাশের বাড়ি থেকে প্রবল ভৌক্ ভৌক্, কুঁ কুঁ শোনা যায়৷ বুলুপিসিও কলেজ থেকে ফিরে এল, এটা সুইটুর খুশীর ডাক৷
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register