Tue 04 November 2025
Cluster Coding Blog

T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || 26য় আবির চক্রবর্তী

maro news
T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || 26য় আবির চক্রবর্তী

ঐশানি

মা বাবার একমাত্র মেয়ে ঐশানি, ডাকনাম এশা; বাড়ির সবার নয়নের মনি। দেখতে যেমন পুতুল-পুতুল, স্বভাবেও তাই। দূর গাঁয়ের একান্নবর্তী দেশের বাড়িতে আছেন সবাই; ঠাকুরদা-ঠাকুরমা,জেঠু-কাকু-দাদা-ভাই-বোন সহ বৃহত্তর পরিবার। তবে কলকাতা শহরে মেয়েটির বাস মা-বাবার সঙ্গে। বাবা-মা দুজনেই সারাদিন কাজে-কর্মে থাকেন ব্যস্ত, তাই ওর সাথে থাকে শিউলিমাসি,ওর মায়ের পাতানো বোন। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই, ওকে ভোরবেলা ঘুম থেকে তুলে স্কুল পৌঁছে দেওয়া থেকে রাতের বিছানায় গল্প বলে ঘুম পাড়ানো,সবটাই মাসি...এমনকি ওর জন্য মাসি নিজের বাড়ি যাওয়াও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে, মা-বাবা যে মাসিকে এজন্য একটু বেশিই ভালোবাসে,তা ও বেশ বুঝতে পারে। আর ওর তো মাসি ছাড়া একমুহুর্তও চলেনা। ও এখন একটু বড়ো হয়েছে ঠিকই, এবার ক্লাশ-এইট হলো; তবু মাসিকে পেলে ও যেন সেই ছোট্টটি হয়েই থাকতে চায়, মাসিও সানন্দে ওর সব আবদার মিটিয়ে চলে। এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো দিন বেশ স্বস্তিতে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে কয়েকদিন ধরে,মাসি হঠাৎ মাকে কিছু না বলেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, মা বারংবার খবর নিচ্ছে, কিন্তু কোন সদুত্তর নেই। এশার ভীষন মনখারাপ,তার চেয়েও বেশি মেজাজ খারাপ। কারন, মাসি চলে যাওয়ার আসল কারনটা ছোট হলেও একমাত্র এশাই জানে, বুঝতেও পেরেছে মাসির অসহায়তা; কিন্তু ভয়ে বলতে পারছেনা সবটা মাকে। আসলে ঘটনাটা হয়েছে কি, গত কয়েকদিনের জন্য ওর এক দূর সম্পর্কের জেঠু এসে আছেন ওদের বাড়িতে, জেঠুমা গুরুতর অসুস্থ, কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি। অধিকাংশ সময়ে জেঠু হাসপাতালে থাকেন, মাঝেমধ্যে ওদের বাড়িতে রাতটুকু ঘুমোতে আসেন। মা-বাবা জেঠুর এই অক্লান্ত সেবা এবং দায়বদ্ধতার প্রশংসা করতেন মাঝেমধ্যে যখন, মাসি কেমন যেন চুপ করে যেত,ও লক্ষ্য করতো। হঠাৎ সেদিন রাতে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায় কোনভাবে,যা দেখেছিলো, জীবনেও ভুলবে না.... ঘুম চোখে দেখে,জেঠু নিজের ঘর ছেড়ে ওদের ঘরে; মাসির খাটের ওপরে বসে জোর করে মাসিকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে, হিসহিসে গলায় কি সব যেন বলছে, চোখগুলো কেমন যেন অস্বাভাবিক ভাবে জ্বলছে...অসহায় মাসী নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে, পারছে না, কাকুতি-মিনতি করছে,কাঁদছে। স্কুলে "ব্যাডটাচ্","গুডটাচ্"শেখানো হয়েছে,ওর মন বলছে, খারাপ কিছু হচ্ছে...ও চিৎকার করতে চাইছে, কিন্তু গলা দিয়ে যেন কোন আওয়াজ বার হচ্ছে না। অনেকক্ষনের চেষ্টায় কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে গলায় শেষে বলে উঠেছিলো.... -"জেঠু... তুমি এখানে?" চমকে উঠলেও, সঙ্গে সঙ্গে ভালোমানুষ সেজে আলো জ্বেলে জেঠুর উত্তর ছিলো, -"মামনি! ঘুম ভেঙে গেল! স্বপ্ন দেখলে নাকি?" ও অবাক হয়ে আবার জিজ্ঞেস করেছিলো, -"তুমি এখানে কেন?" জেঠু অবলীলায় মাসির দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,   -"তোমার মাসি আমাকে ডেকেছিলো,তাই এসেছি। বেশ,বেশ। কাল নাহয় আবার তোমার সঙ্গে বাকি কথা হবে, আজকে আমি এখন যাই, তোমরা ঘুমোও" বলেই তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।   মাসি মুখ নীচু করে খানিকক্ষণ নিঃশ্চুপে দাঁড়িয়ে রইলো, তারপরে দরজায় খিল তুলে দিয়ে ওকে সেই ছোট্টবেলার মতো জড়িয়ে ধরে ভীষণ কাঁদতে শুরু করেছিলো,আর বারবার জড়ানো গলায় বলছিলো, -"তোর জন্য আজ বেঁচে গেলাম, তোর জন্য আজ বেঁচে গেলাম।" বেশ খানিকক্ষণ এভাবে কান্নার পরে, নিজেকে খানিক গুছিয়ে বলেছিলো মাসি, -"আমি এখানে আর থাকবো না, থাকবোনা, থাকা সম্ভবই নয়। কাল সকালেই চলে যাবো। তুই ভালো থাকিস,ভালো থাকিস মা..।" ওরও খুব কান্না পাচ্ছিলো,মাসি ছাড়া ও থাকবে কি করে? কে ওকে স্কুল থেকে নিয়ে আসবে রোজ,গল্প করে খাইয়ে দেবে, স্কুলের আর্ট-ওয়ার্কে সাহায্য করবে, মা-বাবার ফিরতে দেরী হলে, গান শুনিয়ে ওর মন ভালো রাখবে...কে?...কে?... কিন্তু এটাও বুঝতে পারছে ওর ছোট্ট মন,মাসিকে আটকানো উচিত নয়। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে,জানেনা। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনলো, মাকে নাকি কিছু না বলেই চলে গেছে মাসী, শুধু বলে গেছে,ও আর আসবে না,এশাকে সাবধানে রাখতে... মা-বাবার তো দিনকয়েকের মধ্যেই দিশেহারা অবস্থা, অফিস, কাজকর্ম সব শিকেয়; তারমধ্যে জেঠুর দোষারোপ চলছে মাঝেমধ্যে মাসিকে… দিন দুয়েক পরে,সেদিন দুপুরবেলা একাএকাই বসেছিলো মনখারাপ করে, বড়ো হচ্ছে ও,মাসির জন্য কি কিছুই করতে পারেনা ও? তাছাড়া,হলেনই বা আত্মীয়,অন্যায় তো অন্যায়ই...বাবা-মা,স্কুলের ম্যাডামরা বারবার শিখিয়েছেন, তা। বেশ খানিকক্ষণ ভাবলো,তারপরে,আর চেপে রাখতে না পেরে, এশা মাকে বলে দিয়েছিলো সব...ওর খুব কষ্ট হচ্ছিলো মাসির জন্য; মাসিকে সবাই ভুল বুঝছে,ওর ভালো লাগছিলো না একদমই।। মা চুপ করে সব শুনলো, একটা-দুটো প্রশ্ন করলো ওকে। তারপরে, মাসিকে ফোন করে বললো, - "তুমি যদি দিদি বলে এখনও আমায় ভাবো, এখনি একবার এসো" সঙ্গে জেঠুকেও ফোন, -"দাদা একবার বাড়িতে আসুন" দুজনে আসতে ওর ভালোমানুষ মায়ের এক বিচিত্র কঠিন রুপ দেখেছিলো এশা, -" দাদা! এই মুহূর্তে যদি আপনি শিউলির পা ধরে ক্ষমা না চান তো আমি আপনার ভাইকে সব বলতে বাধ্য হবো.." জেঠু মাকে বলতে লাগলেন, -"একটা কাজের লোকের জন্য তুমি আমাকে... আমি তোমাকে..." এশা শুনলো এক কঠিন কন্ঠ, -"আপনি ক্ষমা চাইবেন?" -আস্তে আস্তে মিইয়ে গেল জেঠুর গলা, -"আমি মানে...,আমার ভুল হয়ে গেছে,ক্ষমা করো শিউলি"... -"আমি যেন কখনও আপনাকে আর ত্রিসীমানায় না দেখি" চোরের মতো চলে গেলেন জেঠু, মা মাসিকে পাশে বসিয়ে শুধু একটা কথাই বলেছিলো, -"কান্না নয়,চোখে আগুন জ্বাল,ভাগ্যিস এশা দেখেছিলো, না হলে সবাই তোকেই ভুল বুঝতো তো... নিজের অবলম্বন নিজেই হতে হবে, নিজের মতো করে।" বাইরে তখন বর্ষাশেষের নীলাম্বর জুড়ে ইতিউতি চলছে জলভারহীন মেঘের খেলা, রাস্তার দুধারে দুগ্ধফেননিভ কাশের মেলা, মনে মনে গুঞ্জরণে দেবীর আবাহনী… শিউলি এশাকে জড়িয়ে ধরে বললে, -"জানিস এশা, তুই যদি না থাকতিস সেদিন আমার চরম সর্বনাশ হয়ে যেত, দাদাবাবু আসা ইস্তক আমায় বিরক্ত করতো; আমি ভয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে থাকতাম। সেদিন রাতে টয়লেট যাবো বলে দরজা খুলতেই উনি জোর করে এঘরে... কাউকে বলতেও পারতাম না সে লজ্জার কথা। আর আজও সেই তুইই রক্ষা করলি আমার সম্মান,বাঁচালি আমায়।" একটু থেমে আবার বললে যেন অন্তরের গভীর থেকে, -"তোকে বলিনি কখনও, তোর নাম শুনেই কিন্তু তোকে আমি ভালোবেসেছিলাম; নামটা কেমন যেন অন্যরকম,ভালো লেগেছিলো খুব; আজ বলি, আমি ভুল ভাবিনি, তুই সত্যিই দূর্গা।" আল্হাদি উমা-কিশোরী তখন যেন মাতৃক্রোড়ে লাজে সালঙ্কারা! আর মা! মা দেখছিলেন প্রাণভরে, তাঁর স্বপ্নপুত্তলী কেমন করে যেন অজান্তেই জগন্মাতার রূপ পরিগ্রহ করে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনব্রতে দীক্ষা নিলো স্বেচ্ছায়। দেশে-বিদেশে উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট নিয়ে তুমুল হৈ-চৈ... কিন্তু আমাদের মতো দেশে, যুদ্ধ যেখানে উভয়তঃ বাহিরে এবং অন্দরে, সেখানে পারস্পরিক শুভাকাঙ্ক্ষা ব্যতিরেকে মৃৎপ্রদীপেও সোনার আলো জ্বালানো যায় কি! বড়ো নিশ্চন্ত বোধ করলেন তিনি, পেরেছেন তিনি পেরেছেন; উত্তরাধিকার তাঁর দিশাহীন তো হয় নি… "তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে..."
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register