Wed 03 December 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব - ৩০)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব - ৩০)

শহরতলির ইতিকথা

রাজীবের সান্ধ্য কলেজের ক্লাস পুরোদমে চলছে;ট্যুইশান আর কলেজ সমানে চলছে। রাজীবের কাছে 'মন্ত্রের সাধন নতুবা শরীর পতন'--মরন পণ, না আছে বাড়িতে পড়াশোনার পরিবেশ, না আছে বইপত্র--আছে শুধু অদম্য জেদ, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সাধনা। কলেজের সহৃদয় লাইব্রেরিয়ান মশাই তাকে উৎসাহ যোগায়। বাড়িতে যে ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কট দেখা দেবে, সে তো আগেই ভবিষ্যতবাণী করেছিল, সেটা এখন প্রকট হয়ে হাজরা পরিবারকে ভেংচি কাটছে। স্কুলের এক বন্ধুর পরিবার, উদ্বাস্ত অবস্থায়, চাটুজ্জেদের ঠাকুরদালানে আশ্রয় নিয়েছিল; মেইন রাস্তার ধারে, চাটুজ্জেদের জায়গায় প্রথমে একটা মুদিখানা দোকান করে, স্কুল জীবন চালিয়েছে; সরকারি আবাসনের জায়গা পাবার পর,তারা কলোনীতে বাড়ি করে চলে গেছে,তবুও দোকানের ঘরটা ছাড়েনি।ট্যুইশান করে এসে রেস্ট নেয়,আবার, রাত্রিতে ট্যুইশান শেষে, পড়ে এখানে, ইলেকট্রিক আলো আছে; কলোনী এলাকায় এখনও ইলেকট্রিক আলোর ব্যবস্থা হয়নি। বন্ধুটি, চুঁচুড়ার মহসীন কলেজে দিনের বেলা ইতিহাসে অনার্স নিয়ে পড়ছে; তো দিনের বেলায় ঘরটা ফাঁকা, তালাবন্ধ থাকে;রাজীব, তার কাছ থেকে চাবির ডুপ্লিকেটটা নিয়ে, দিনের বেলায় ট্যুইশান সেরে এসে, সেখানে নিজের পড়ার ব্যবস্থা করেছে;আর মাস তিনেক পরেই পরীক্ষা; টেষ্ট পরীক্ষার ফল ভালোই হয়েছে; এবার ফাইন্যাল পরীক্ষা হলেই সে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে পারবে। সজীবের আবার একটা মেয়ে হয়েছে, সেটাও ঐ শ্বশুর বাড়িতেই হয়েছে;সজীবের স্ত্রী, পারতপক্ষে হাজরা-পরিবারে, না আসতে পারলেই যেন বেঁচে যায়! আর সজীবও এখন, প্রায়ই শ্বশুর বাড়ি থেকেই কারখানায় যাওয়া আসা-আসা করে, এ সংসারের প্রতি তার টানটা কমছে। হাজরামশাই'র সঙ্গে,তার প্রায়ই টাকা-পয়সা দেওয়া নিয়ে বাগ্-বিতণ্ডা হয়--- ভবিতব্য তো এটাই। রাজীবের গ্রাজুয়েশন(বি কম) পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ভোর থেকেই ট্যুইশানের জন্য, সে বেড়িয়ে যায়। বেলা সাড়ে ন'টা নাগাদ পড়িয়ে এসে, বাজারে, নচুর দোকানে চা - টোস্ট খায়। এরপর, লাইব্রেরিতে খবরের কাগজে একটু চোখ বুলিয়ে, সেই বন্ধুর দোকান - ঘরে এসে বন্ধু ও সে, কখনও, কখনও বা আরো অনেকে বসে, সবাই মিলে গল্প-গুজবে জীবনে বেঁচে থাকার রসদ খোঁজায় ব্যস্ত হয় । একদিন, রাত ন'টা নাগাদ, পাড়ার মাঠে, কয়েকজন বসে আছে, এমন সময় পাড়ার একজন এসে বললো, স্থানীয় চটকলে এক্সসাইজ ডিউটির কাজের জন্য একজন ক্লার্ক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দিয়েছে (এই প্রথম এক্সসাইজ ডিউটি চালু হয়েছে)। রাজীব, শোনা মাত্রই মনস্থির করে ফেললো; পরের দিন, সকাল দশটা নাগাদ, ঐ মিলের লেবার অফিসারের অফিসে, নিজের দরখাস্ত ও সার্টিফিকেটের কপি জমা দিয়ে এলো। পরীক্ষার রেজাল্ট বেড়োতে এখনও প্রায় আড়াই মাস মতো বাকি আছে, এ সময়টা কিছু টাকা রোজগার করতে পারলে, বাড়িতেও টাকা দিতে পারবে, আবার নিজের পোস্ট-গ্রাজুয়েট পড়ার রসদটাও হয়ে যাবে; যদিও জানে তার দেওয়া অর্থে সংসারের অভাবরূপ 'ঘোঘ' বন্ধ হবে না। কয়েকদিন পরে ইন্টারভিউ হলো; লেবার অফিসার ও কারখানার ম্যানেজার তাকে জিজ্ঞেস করলো, "How much money do you expect here?" তার মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেল, "expect one hundred twenty rupees".

"Ok, join tomorrow".বাড়িতে খুশির হাওয়া; হৈমবতী,বললো, "আমায় সোনার চুড়ি গড়িয়ে দিবি," ভাই-বোনেরা, যে যা পারছে,চেয়ে যাচ্ছে,মানুষের চাওয়া বা পাওয়ার তো শেষ নেই; প্রত্যেকেই নিজের নিজের পাওনা পেতে তৎপর,কতটা যুক্তিযুক্ত, তা বোঝার প্রয়োজন নেই।হাজরা, নিজের কারখানার ইউনিয়নের সহায়তায় নাকি সজীবের চাকরি করে দিয়েছে,অতএব সে হাজরা-দম্পতির কথা মত চলতে বাধ্য, এটাই ওদের অভিমত; কিন্ত, রাজীবের ক্ষেত্রে তো আর তা চলবে না; একটু চাওয়া মাত্র, সেই স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষার পর থেকে, তাকে নিজের জামা-কাপড় থেকে আরম্ভ করে, সব কিছুই নিজের ট্যুইশানের উপর নির্ভর করে চালাতে হয়েছে; এটা তো প্রত্যাশিত নয়; বন্ধুদের বাবা-মা'র কী রকম অপত্যস্নেহ,আর তাদের পরিবারে! পোস্ট-গ্রাজুয়েশন করার উৎসাহ দানের কোনো নাম গন্ধ নেই; সংসারে টাকা দাও,তাহলেই 'গোপাল নাচবে',আহা,কী সুন্দর! যাই হোক,কোম্পানির অফিসে জয়েন করে,পুরোনোদের বিদ্বেষের শিকার হতে হোল। আট আনা, চার আনা বছরে ইনক্রিমেন্ট হয়েও অনেকেরই মাইন এখনো একশো ক্রশ করেনি, আর এই বাচ্ছা ছেলে ঢুকেই ওদের চেয়ে বেশি পাবে, এ তো ভালো কথা নয়; অতএব প্রতিপদে রাজীবের ভুল ধরতে তারা উদগ্রীব। রাজীবের হাতের লেখা, পড়া যায়, তবে সুন্দর নয়;অতএব গুঞ্জন শুরু। এদিকে, ফোন-ট্রাঙ্কল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ছেলেটির সঙ্গে রাজীবের খুব ভাব হয়ে গেছে; রাজীব,সময় পেলেই কলেজে ফোনের (ট্রাঙ্কল) মাধ্যমে রেজাল্ট সংক্রান্ত প্রশ্ন করে। তখনকার দিনে ফোনের মাধ্যমে, দূর অঞ্চলের সঙ্গে কথা বলতে গেলে, যথেষ্ট গলার জোর লাগতো, তো সবাই শুনতে পেত; রাজীবের উদ্বেগ জানতে পেরে, পুরোনোরা, ঈর্ষাজনিতে, অন্যদের দেখিয়ে, বিদ্রূপ করে বলতে শুরু করে, "ওরাও তো এবার পরীক্ষা দিয়েছে , কই,ওদের তো এমন উদ্বেগ দেখি না" ইত্যাদি, ইত্যাদি।রাজীব, ওদের মনের জ্বালা বুঝতে পারে। যে ছেলেটি,ওর জায়গায় 'বদলী-হিসেবে' আগে কাজ করতো,রাজীবের জন্য, সে আর পারমানেন্ট পোস্টে চাকরির জন্য মনোনীত হয়নি; তাকে রাজীব কথা দিয়েছে, রেজাল্ট বেরোতে সে ইস্তফা দেবে, এবং তার চাকরির ব্যবস্থা করবে; কথাটা যেন গোপন থাকে। প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে সে মায়ের হাতে, ছ'গাছা ব্রোঞ্জ মিশ্রিত সোনার চুড়ি গড়িয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় মাসের মাইনের অর্ধেক হাজরামশাই'র হাতে, বাকিটার কিছু অংশ ঐ ছোটো ছোটো শহোদর-শহোদরার আবদার মেটাতে ব্যয় করলো। পরের মাসের ১৮ তারিখে রেজাল্ট বেরোলো। রাজীবের ফল ভালোই হয়েছে; অফিসের অন্য যারা পরীক্ষা দিয়েছিল,না, কেউই পাসও করতে পারেনি। ২০ তারিখে,ইস্তফা পত্র লিখে ও, সেই 'বদলীতে' কাজ করা ছেলেটির আবেদন পত্র নিয়ে, কারখানার ম্যানেজারের চেম্বারে হাজির হল। ম্যানেজার চেয়ার থেকে উঠে হ্যাণ্ডসেক করলো। রাজীব, নিজের ইস্তফা পত্র পেশ করেছে। ম্যানেজার, তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যবিভাগে পড়ার অনুরোধ করলো, সব ব্যবস্থা করে দেবে কোম্পানি;কিন্ত না, এ অঞ্চল থেকে কোলকাতায় রাত্রিতে পড়া,সম্ভব নয়।ম্যানেজারও সেটা বুঝতে পারলো; রাজীব, ইস্তফার সাথে, সেই ছেলেটির আবেদন পত্রটা এগিয়ে দিয়ে, ছেলেটির আবেদন পত্র মঞ্জুর করার অনুরোধ করলো, এবং সে যে কথা দিয়েছে, এ কথাও বলায়, ম্যানেজার, রাজীবের উদ্যোগকে প্রশংসা জানিয়ে, ছেলেটির আবেদনপত্র সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জুর করে দিল,এবং বললো, "wish you good luck।" ক্যাসিয়ারের কাছ থেকে ঐদিন পর্যন্ত যা টাকা হয়, তা নিয়ে যেতে বললো, এবং ক্যাসিয়ারকে ডেকে নির্দেশ দিল।

অফিসে সাড়া পড়ে গেছে। সবাই বললো, "তুমি যে রেজিগনেশন দেবে,একবারও বললে না।" রাজীব তো, ঐ ছেলেটির কাছে আগেই জেনেছিল, ঐ পোস্টের জন্য অনেক দাবীদার আছে, ইউনিয়ন- বাজি আছে,তাই তো একেবারে পাকা কাজ করে, ছেলেটিকে, ঐ পোস্টে বসিয়ে সে চটকলকে বাই-বাই জানিয়েছে। ঐ কুড়ি দিনের টাকায়, পোস্ট-গ্রাজুয়েটে ভর্তির টাকা সংগ্রহ হয়ে গেছে। প্রথমে সব টাকা দিয়েই ভর্তি হতে হল, ফ্রি/হাফ- ফ্রি দরখাস্ত পরে দেবার নিয়ম। সে এখন দিনের বেলায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম-কমের, মানে কমার্সের, ফিফ্-প্ত ইয়ারের ছাত্র হল; ভর্তির দিনে, হয়েছে এক মজা -

হুগলি-ঘাটের থেকে দু'জন পুরোনো সহপাঠী আছে, কেউই তো কখনও এপথে আসেনি।হাওড়া থেকে দোতলা বাসে চেপে, কলেজ-ষ্ট্রিটে তো হলো নামা,এবার জিজ্ঞেস করে প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে এসে, যাকেই জিজ্ঞেস করে, বলে সামনে যান,সামনে শুধুই দোকান, সিনেট-হল ভাঙ্গার গুম গুম আওয়াজ; এগিয়ে দেখে সেলস-কাউন্টার;সেখানে জিজ্ঞেস করতেই বলে, এগিয়ে গিয়ে ডানদিকের গলি।না, এখানে সহমর্মীতার বা একটু ধৈর্য ধরে বলা, না, না, ওসবের বালাই নেই। উল্টোদিকে,সামনে কলেজ স্কয়ারে বিদ্যাসাগর মশাই, চুপচাপ বসে হয়তো মুচকি মুচকি হাসছিলেন। যা হোক, তিনজনে কয়েক পা এগোতেই, এলো ডানদিকের গলি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢোকার গেট কোথায় রে বাবা! এ যে সোজা রাস্তা; যা হোক কয়েক পা এগোতে, ডানদিকে দেখা গেল বিশাল দর-ওজা, রাস্তা থেকে তো ভিতরে অন্ধকার বলেই মনে হচ্ছে,তার মধ্যেই ঠাহর করে দেখা গেল উপরে ওঠার বিশাল চওড়া কাঠের সিঁড়ি। তিন পুঙ্গব উঠছে দোতলায়, ছাত্র-ছাত্রী তো চোখে পড়ছে না; একটু দোতলায় ঘোরাঘুরি, এবার আসা হোল তিন তলায়, একটু ঘুরতেই মিললো দেখা'Staff-Room', আর তারই উল্টোদিকের পাশের ঘরটার দরজায় লেখা 'Commerce--Office-Room'। ভিতরে একজন বসে আছেন; বেশ কৃত্রিম গম্ভীর হয়ে বললেন, "কী নাম?"

লিষ্ট দেখে নিয়ে, কী অমায়িক ভাবে তাদের ভর্তি করিয়ে নিলেন, যেন তাদের পরম বন্ধু; বুঝলেন,তারা সবাই মফঃস্বল থেকে এসেছে, আর এই প্রথম বোধহয়, এ পাড়ায় তাদের আর্বিভাব। বললেন "সব ঘুরে দেখ,এক তলায় আছে ক্যান্টিন, ইচ্ছা হলে খুব কম পয়সায়,সেখানে টিফিন সেরে নিও।"

 চলবে

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register