Wed 03 December 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব - ২৯)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব - ২৯)

শহরতলির ইতিকথা

গোঁশাই দাদুর শেষ পারলৌকিক কাজকর্মের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। গোরার মেশোমশাইরা যতটা কম খরচায় কাজ উদ্ধার করতে মনস্থ করেছেন। যাই হোক, পাড়ার ছেলেদের যা কাজের হুকুম করছেন,ছেলেরা,নির্বিবাদে তা পালন করে চলেছে।গোরাদের গার্জেন বলতে এখন ওনারাই, গোরার ব্যাঙ্কের চাকরি তো ওনারাই করে দিয়েছেন; ওদের মতের বিরুদ্ধাচরন করা গোরাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ভিতর বাড়িতে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে,আর সংলগ্ন গোয়াল বাড়িতে লোকজনের আপ্যায়ন ও খাওয়ানোর আয়োজন হয়েছে। গোয়াল বাড়িতে ছেলের দল, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের দিন বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রয়েছে; গোরা,ভিতর বাড়িতে এক প্রস্ত পারত্রিক কাজ সেরে, গোয়াল বাড়িতে বন্ধুদের সংগে রয়েছে,ডাক পড়লেই ভিতর বাড়িতে আবার যাবে; এমন সময়,কয়েকজন বামুন এসে গোরাকে জিজ্ঞেস করছে, "ব্রাহ্মণ ভোজনের ব্যবস্থা কোথায় হয়েছে"। রাজীব,তা শুনে,বললো," এখানেই সবার ব্যবস্থা হয়েছে; অবশ্য, রমেনের বাবা,ন্যায়তীর্থ মশাই'র কাছে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলে, তখন,আলাদা ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা যেতে পারে, কি রাজি তো?" "যত সব ডেঁপো ছোঁড়া"বলতে বলতে বামুনগুলো ভিতর বাড়িতে ঢুকলো। গঙ্গা কাকা,ভিতর বাড়ি থেকে আসতেই রাজীব-রমেনের দল বললো, "আচ্ছা কাকা, তুমিই বল, এরা কি কেউ ব্রাহ্মণ? পুজোর ব্যবসা করে টাকা আয় করে; তুমি যে পিতলের সাজি নিয়ে দোকানে, দোকানে ঘোরো, গণেশের মাথায় ফুল, আর জল দাও, মাসের শেষে দোকান থেকে পয়সা নাও, তা তো তোমার পুজো ব্যবসা ছাড়া কিছু নয়, তুমি তো আর নিজেকে ব্রাহ্মণ বলতে পারো না; বড় জোর বলতে পারো পুজুরি বামুন; আবার যখন তুমি অনুষ্ঠানাদিতে রান্না কর, তখন তুমি রাঁধুনি বামুন,ঠিক কি না!। এই দেখ না,রমেনও ওর দাদা,বাবার মত ন্যায়তীর্থ না হয়ে,কারখানায় কাজ করছে, শূদ্রের কাজ করবো, আবার নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে জাহির করবো,তা তো চলবে না এ যুগে; এ যুগ সাম্যের যুগ,এখানে আধিপত্য দেখাতে এলে তোমাকে, তোমার বিশেষ যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে, ফোকটে রক্তের ধারা দেখিয়ে, পৈতে দেখিয়ে,মান্যতা মিলবে না। গঙ্গাকাকা বললো,"ওদের নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না, মেশোরা বলে পাঠালেন, ওঁদের ভিতর বাড়িতেই ব্যবস্থা করছেন", বলে কাকা আবার ভিতর বাড়িতে চলে গেল। রজত-রমেনরা বুঝলো, মেশোরাও তো বামুন, তাই সব শেয়ালের এক 'রা'।

পারত্রিক কাজ শেষ। গোয়াল বাড়িতে আত্মীয়,কুটুম্ব,পাড়া-পড়শিরাও দাদুর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পাত পেড়ে খেয়ে দাদুর গুণগান করতে করতে চলে গেছে।দাদুর উকিল মশাই, তাঁর ব্যাগটা গুছিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,"গোঁশাই মশাই,দেহ রাখার আগে একটা উইল মাধ্যমে, সব সম্পত্তির বিলি-বন্টনের ব্যবস্থা করে গেছেন; আপনারা, ওনার ওয়ারিশানরা, এক জায়গায় জড় হলে, আমি, ওনার ইচ্ছামত উইলের বক্তব্য সংক্ষেপে, আপনাদের শুনিয়ে আমার উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করতে পারি।

সম্পত্তির বন্টনের কথায়, সবাই উৎসুক হয়ে,সব কাজ ফেলে, ভিতর-বারান্দায় উপস্থিত হয়েছে;সবাই এসেছেন শুনে, এবার উকিলবাবু ব্যাগ থেকে একটা মুখবন্ধ খাম ও একটা কোর্ট পেপার বের করেছেন।

খামটা দেখিয়ে,উকিল বাবু বললেন, "গোঁশাই মশাই এ খামটি সকলের সামনে খুলতে বলেছেন; বিলিবণ্টনের ব্যবস্থাপনা উপস্থিত করার আগেই এটা পড়ার কথা,আমাকে মুখে নির্দেশ দিয়ে গেছেন। আমি কি এবার খামটা খুলে পড়তে পারি?"

সবাই উৎসুক হয়ে,"হ্যাঁ আপনি পড়ুন" বলবার পর উকিলবাবু খামটা ছিঁড়ে পড়তে শুরু করলেন-----

"আমার প্রজন্মের অবগতির জন্যই এই লেখা।আমি,যা আমার ঠাকুরমার কাছ থেকে জেনেছি, তাই তোমাদের কাছে উপস্থাপিত করছি।ঠাকুরদা,অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক ছিলেন,মরা মানুষের টিপ সই নিয়ে অনেক লোকের সম্পত্তি দখল করেছেন। কত যে অনূঢ়ার পানি গ্রহন করে, তাঁদের কৃতার্থ করেছেন, তাঁর খাতা দেখেই তা বুঝতে পেরেছি। ঠাকুরদা, গুরুগিরি করতেন, শিষ্য / শিষ্যার বংশ রক্ষার দায়িত্বও নিতেন। যে ঘর দুটোয় আমার ছেলেদের পাগল অবস্থায় আটকে রাখা হোত, ঐ ঘর দুটোয় বংশ রক্ষার কাজে ব্যবহৃত হোত। আমার বাবাও পিতার পদাঙ্ক অনুসরন করেছেন। ঠাকুরদার বাবা কেমন ছিলেন,তা স্পষ্ট ভাবে না জানায়, তাঁকে আর এখানে টানলাম না।  পিতৃপুরুষদের পাপের ফল, আমি ও আমার পুত্ররা ভোগ করে,আমার নাতি/নাতনিদের শাপমুক্ত করার প্রয়াস করে গেলাম। আমার স্ত্রী বিয়োগের পর, মৃত্যুশয্যায় শায়িত ঠাকুরমার পরামর্শে আমার এক পিসির সন্ধান পাই; তাঁর স্নেহ-ছায়াতেই আমার মাতৃহারা সন্তানেরা বড় হয়।আজ যা হতে চলেছে,সবই ঠাকুমার ইচ্ছে অনুসারে হতে চলেছে।এ বাড়িতে অন্যায়,অত্যাচার,অনাচার অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমি,আমার সন্তারেরা পূর্বপুরুষদের পাপের ফল ভোগ করে গেলাম।আমার প্রজন্ম যেন সত্বর এ অভিশপ্ত বাড়ি পরিত্যাগ করে, তারা যেন অন্যত্র বাড়ি করে চলে যায়,অভিশাপ মুক্ত হয়।এই চিন্তা করেই,সম্পত্তির বিলি ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবাই সুখী থেকো।" 
ইতি----দাদুর সহি রয়েছে 
            বংশের ধারা শুনে সকলের মুখ থমথমে।
এবার উকিলবাবু,সংগের কাগজ থেকে শোনালেন-----
"আমার,উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সমস্ত সম্পত্তি যথা---

ক) বাজারের দোকানঘরগুলো সব স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটির নামে হস্তান্তর করা হোল; ওরা ঘরগুলোতে থেকে প্রাপ্ত ভাড়াও অন্যান্য আয় থেকে অঞ্চলের প্রাইমারি বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রবৃত্তির ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হবে।

খ) এ বাড়িও সংলগ্ন জায়গার মধ্যে শিবমন্দিরও জাগৃতি সংঘের জন্য বিশ শতক জায়গা ও পুকুর বাদে,সবই দলিলে লিখিত মিশনের নামে হস্তান্তরিত হবে।

গ) সংঘের উল্লেখিত জায়গার সংলগ্ন পুকুরের আয় থেকে সংঘ,নিত্য শিবপুজোও গাজনের ব্যবস্থা করবে।এবার আমার স্বোপার্জিত সম্পত্তির বিলি-বন্টন:---

ক) ব্যাঙ্কের জমা (১০০০০০)অর্থ থেকে----

    ১) বড় বৌমা -১৫000টাকা

   ২) ছোট বৌমা -১৫000টাকা

   ৩) রাণী (নাতনি) -৩০০০০টাকা

   ৪)গোরা( নাতি) -১৫০০০টাকা

    ৫) কৃষ্ণ (নাতি) -১৫০০০টাকা

    ৬) বাকি অর্থ,শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

স্থাবর সম্পত্তির (১২কাঠা) বিলি-ব্যবস্থা--

খ) রাস্তার দক্ষিন দিকের বাস্তু জমির

 মধ্যে---

  ১ ) গোরা - ৫ কাঠা

  ২) কৃষ্ণ - ৫ কাঠা

 ৩) গঙ্গা - ২কাঠা

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব,গোরা-কৃষ্ঞ,উপরে বলা জমিতে বাড়ি করে উঠে যাবে।

গঙ্গার নামে দেওয়া জায়গা,গঙ্গা ইচ্ছামত যা কিছু করতে পারে,তবে ঘর করে থাকলে ,ভালো হয়।

ইতি--

অভিশপ্ত বংশের (আশা করি) শেষ ভুক্তভোগী--

নরেন্দ্রচন্দ্র গোস্বামী

বিলি-বণ্টনও খামের বিষয় বস্তুতে

সকলের মুখে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ছে।

চলবে

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register