- 6
- 0
আধুনিক সমাজের তথাকথিত আধুনিক নারী শ্রীমতি মোহর সরকার। পুজোয় ঘুরতে বেরিয়েছে স্বামী ও পুত্র সহ। কলকাতার পুজো ছেড়ে এবারে প্রথম এই আধা শহর আধা গ্রামে। বরের বারংবার বলার পর এখানে আসতে রাজি হয়েছেন, কিছুটা বাধ্য হয়েছেনও বলা যায়। হাজার হোক নিজের শ্বশুরবাড়ি বলে কথা। তাছাড়া এভাবে কতদিনই নিজের বরকে তার বৃদ্ধা বিধবা মায়ের থেকে আলাদা রাখা যায়... কলকাতার মতো আধুনিক শহর ছেড়ে এই অখ্যাত একটা শহর যেখানে নাইট ক্লাব নেই, ফাইভ স্টার হোটেল নেই, আধুনিক শপিং মল নেই, শুধু নেই আর নেই। এখানে তাই একদম ভালো লাগছেনা মোহরের।
রাজা বারবার বলেছিলো উত্তর বাংলার প্রকৃতির যে অপূর্ব শোভা তা দেখে তুমি মোহিত হয়ে যাবে।কি নেই এখানে দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়, সবুজ গালিচার মতো চায়ের বাগান, গহীন অরণ্য, পাহাড়ের বুক চিরে আসা নদীর ঝরনা আর সর্বোপরি এখানকার মানুষগুলোর সাদাসিধে মন...
মোহরের এইসব কিছুই ভালো লাগছিলো না। মন পড়ে আছে সেই কলকাতার বিলাস বহুল জীবনে। এই কয়েকটা দিনেই যেনো হাঁফিয়ে উঠছিল...
এগুলো কোনো পুজো হলো নাকি! ছোটো ছোটো সব পুজো, তাই দেখতে কাতারে কাতারে মানুষগুলো সব কিলবিল করছে। রাস্তার ধারে কিছু নোংরা কাপড় পড়া ভিক্ষুক ভিক্ষা করছে। ছিঃ! এই তোমাদের পুজো, স্বামীকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বাড়ি যাওয়ার তাড়া দিলো মোহর...
মাকে রাজা অনেক বার বলেছিল তাদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার জন্য... মা যেতে রাজি হননি। বলেছিলেন আসার সময় কয়েকটা সন্দেশ নিয়ে আসতে, কাল বিজয়ার দিন দুর্গা মায়ের মুখে দিয়ে একটু পূজা দেবেন... এই কারণেই শহরের এক মিষ্টির দোকানে সস্ত্রীক রাজা গিয়ে কিছু মিষ্টি কিনতে ঢুকলেন... কাকীমা, ও কাকীমা--- দুদিন থেকে কিছু খাইনি কিছু খেতে দাওনা গো... গায়ে একটা নোংরা জামা, খালি পা, চুলগুলো সব এলোমেলো একটা বছর দশেকের ছেলে মোহরের হাত ধরে বলছে... দিলি তো সব নোংরা করে... তোর এতবড় স্পর্ধা এই নোংরা চেহারার হয়ে আমার গা স্পর্শ করেছিস. বলতে বলতেই এক কষিয়ে চড় ছেলেটার গালে... দেখতে দেখতে অনেক মানুষের জটলা হয়ে গেলো... মোহরের রাগ যেনো কিছুতেই কমছে না... চড়ের পর চড়.. ধাক্কাধাক্কি হুড়োহুড়ি... অনেক কষ্টে রাজা মোহরকে ক্ষান্ত করে বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছে...
কইগো শুনছ... আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে... সব শেষ হয়ে গেছে... তোমাদের শহর আমাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে... কেঁদে কেঁদে রাজাকে বলছে মোহর... কি হয়েছে বলবে তো?... কলকাতার বাড়িতে কেউ নেই বলে আমি আমার সমস্ত গয়না, নগদ টাকা, পাশবুক, এটিএম কার্ড সমস্ত কিছু যে ব্যাগটায় করে এনেছিলাম সেটা পাচ্ছিনা... মনেহয় ওই মিষ্টির দোকানের ঝামেলার সময় হারিয়ে গেছে... এখন আমার কি হবে গো... ও মা... গো...
এখনতো অনেক রাত.. কি করবো বলো? দেখি সকাল হলে কি করা যায়...
সারারাত দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি মোহর... কখন যে চোখদুটো লেগে এসেছে... কলিং বেল খুলতেই.... একি.. এইতো সেই নোংরা ছেলেটা, যাকে কাল রাতে আমি উচিৎ শিক্ষা দিয়েছিলাম... ও আমাদের বাড়িতে কি করতে এসেছে?... বদলা নিতে?... তাছাড়া ও আমাদের বাড়ি চিনলই বা কেমন করে?... ওর সাথে আরো দু তিনজন এসেছে, তাহলে মনেহয় কিছু একটা করবে বলেই এসেছে...
কিছু বোঝার আগেই নোংরা জামা পরা ছেলেটি একটা বস্তা থেকে মোহরের হারিয়ে যাওয়া ব্যাগটি বের করে দিলো... বলল কাকীমা ভোর বেলায় কাগজ কুড়োতে গিয়ে আমি এটা পেয়েছিলাম ওই মিষ্টির দোকানের পাশের নালাটায়...
নির্বাক মোহর... নির্বাক রাজা... চোখের জল কখন যে শ্রাবণের ধারার রূপ নিয়েছে মোহর তা বুঝতেই পারল না... আদরে আদরে ভরিয়ে দিলো সেই তথাকথিত নোংরা ছেলেটিকে... জানতে পারলো ও একজন অনাথ নাম পলাশ...
আজ থেকে তুই আমার দ্বিতীয় ছেলে... আমাদের সাথেই তুই থাকবি। তোর সব দায়িত্ব আজ থেকে আমার... আর কাকীমা নয়, আমাকে মা বলেই ডাকবি...
একটা ঘটনা যেনো এক ঝটকায় সব পরিবর্তন করে দিলো মোহরের জীবন...
রাজা, সত্যিই... তুমি যে বলতে তোমাদের এখানকার সরল মানুষগুলোর কথা! আমি আজ মুগ্ধ... আমি আজ পরিপূর্ণা,... আমি আজ গর্বিত... আমি আজ নিজেকে খুঁজে পেয়েছি নতুন করে... আমি আর কলকাতায় ফিরে যাবোনা... এখানেই থাকবো... আর ওই না খেতে পাওয়া মানুষগুলোর জন্য কিছু করার চেষ্টা করে যাবো...
0 Comments.