- 72
- 0
শহরতলির ইতিকথা
শহরের লাইব্রেরি,গর্বের প্রতিষ্ঠান; না, সরকারী নয়, স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের সৌজন্যে ও অনুদানে, বিশেষ করে স্থানীয় রাজবাড়ির আনুকূল্যেই এ প্রতিষ্ঠান; জেলার উত্তরপাড়া লাইব্রেরির পরই সবচেয়ে বড় এই প্রতিষ্ঠান, জেলার ইতিহাসে একথা উল্লেখিত হয়। সব সময়,ছাত্র-ছাত্রীদের, পাঠকের আনাগোনা।লাইব্রেরির হলঘরে রয়েছে বিশাল লম্বা আকারের মেহগিনি কাঠের টেবিল,দু'ধারে সারি সারি একশোটা হাতল-বিহীন চেয়ার;টেবিলের উপর দৈনিক সংবাদ পত্র ও নানা ম্যাগাজিনের সমাহার। হলঘরে ঢোকার মুখেই আছে কাউন্টার।লাইব্রেরিয়ান ও তাঁর সহকারি স্লিপের ফরমাশ অনুযায়ী ভিতরের বই'র তাক থেকে বই খুঁজে এনে পাঠকের হাতে তুলে দেন; খাতায় সই করে,বই হাতে পাঠকেরা চলে যায়। দৈনিক প্রায় চারশো মত পাঠক বই পাল্টিয়ে,নতুন বই নিতে কাউন্টারে এসে থাকে;এ থেকে বোঝা যায়,অঞ্চলের মানুষের শিক্ষা-সচেনতা;সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ।প্রায়ই, লাইব্রেরির বন্ধের দিনে, হলঘরে অনুষ্ঠিত হয় সভা,আবৃত্তি প্রতিযোগিতা ও নানা অনুষ্ঠান।
হলঘরের মধ্যেই পিছনের দিকে রহেছে উঁচু প্লাটফর্ম;তলায় পিছনের মাঠের দিকে পিলার তৈরি করেই তা করে,হলঘরের সংগে সংযুক্ত করা হয়েছে।সভা/অনুষ্ঠানের সময় মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়;অন্য সময়,এর উপরে থাকা বোর্ডে টেবিল-টেনিস খেলা হয়।রজতরা,সময় পেলে রাতে,লাইব্রেরির কাজ মিটে গেলে,টেবল-টেনিসে হাত পাকায়।
লাইব্রেরির পিছনের মাঠে, বিকেল -বেলায় আসে-পাশের বাড়ির মেয়েরা বসে গঙ্গার হাওয়া খেলেও,সন্ধেবেলায় সবাই যে যার বাড়ি চলে যায়। একপাশে,ভলিবল কোর্টে,ছেলেরাও খেলা সাঙ্গে, বসে হাওয়া খায়। একটু অন্ধকার ঘনিয়ে এলে,রজতের বয়সী ছেলেরা, নিজেদের ট্যুইশান ও কাজকর্ম শেষ করে এসে বসে, গল্প-গুজব করে,ক্লান্তি দূর করে,জীবনীশক্তি সঞ্চয় করে।
এই মাঠেই, আজাদ হিন্দ্ বাহিনীর (আই এন এ) কর্নেল ধীলন,লালকেল্লার বিচারের কিছুদিন পরেই, এসে বক্তৃতা দিয়েছিলেন;নেতাজী, অন্তর্ধানের ঠিক পূর্বমুহূর্তে , সেনানীদের সামনে কী বলেছিলেন,তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উপস্থাপন করেন;নেতাজীর দাদা,সুরেশ বসু মশাইও ছবির মাধ্যমে নেতাজীর মৃত্যু যে বিমান দুর্ঘটনায় নয়,সবটাই বিপক্ষকে ধোঁকা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই সাজানো প্লট,তা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।এ অঞ্চল, নেতাজীর নামে আপ্লুত;নেতাজীর প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড ব্লক,এ অঞ্চলে খুবই সক্রিয়।
হলঘরের আলো জানলা দিয়ে মাঠে পড়ে; দু'পাশের জেলেপাড়ার টালির ঘরের ফাঁক দিয়ে,ধোঁয়ার কুণ্ডলী অস্পষ্ট ভাবে আকাশের পানে ছোটে;কিছুটা দূরে ইট খোলার ইট-ভাটার চোঙ্ থেকেও ধোঁয়ার রাশি অনন্তের দিকে ছুটে চলে; সেখানকার শ্রমিকদের কোলাহলও অস্পষ্ট ভাবে কানে আসে;সামনে হুগলী নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ ঐক্যতান সুমধুর,প্রাণে জানায় স্পন্দন,মাঠে বসে আঠারো-উনিশ দেখে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
লাইব্রেরির পাশ দিয়ে ইট বাঁধানো পথ নেমে গেছে হুগলী নদীর জলের দিকে;নদীর খাত দেখলেই বোঝা যায়,অতীতে গঙ্গা কেমন ছিল,তাই মাঠটা রাস্তা থেকে অনেক উঁচু,মাঠের শেষে পনেরো ইঞ্চি দেওয়াল দিয়ে মাটির ক্ষয় রোধ করা হয়েছে; তারপর রয়েছে ইটের খোয়া দিয়ে তৈরি রাস্তা,ইট খোলার মালিকরাই,নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে তৈরি করেছে। শহরের মেইন রাস্তা থেকে লাইব্রেরির দক্ষিন দিক দিয়ে নেমে আসা পথের মাঠ বাদ দিয়ে, দুদিকেই রয়েছে জেলেপাড়া,আর মাঠের শেষের ইট-বাঁধানো পথ,দু'দিকের বাসিন্দাদের সংযোগ রক্ষা করে চলেছে। রাস্তার পরই নেমে গেছে নদীর খাত। বর্ষায় বানভাসি হলে,জেলেরা সপরিবারে এসে স্থানীয় স্কুলগুলোতে আশ্রয় নেয়।
বর্ষায় জল,লাইব্রেরির পিছনের পিলার পর্যন্ত কখনো কখনও উঠে আসে। তখন,জেলেপাড়া ঘর ছাড়া হলেও, অঞ্চলের রান্নাঘর ও আশ-পাশ,রূপালী ইলিসের সুবাসে মৌ,মৌ করে;তখন আর ওজন করে কেন-বেচা নয়, হয় ঠাউকোতেই বেচা-কেনা। রাতের অন্ধকারে রজতেরা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে বলে, 'কর্তা! আছে নাকি?' মাছ শব্দ রাতে উচ্চারন করতে মানা,উত্তর আসবে না। যদি উত্তর আসে, 'আছে '; 'পাড়ে ভেড়াও' বললে,তখন পাড়ে নৌকো ভিড়বে; চলে ঐ অন্ধকারের মধ্যেই বেচা-কেনা; সময় কোথায়,আবার লেনদেন শেষ হতেই ত্বরিতে বায় নৌকো, রূপালী ফসলের অনুসন্ধানে। জেলেপাড়ায় সবারই কর্মব্যস্ততা; মুখে সকলেরই হাসি
আহা! নদী উজাড় করে দিচ্ছে তার ফসল;নদী যে তাদের জননী, মাতৃ-বক্ষের সুধায় তারা আত্মহারা,গলায় তোলে ভাটিয়ালি,রাতের বাতাস বহে নিয়ে যায় তা দূর-দূরান্তরে। শান্তি-স্বস্তির আভাস অঞ্চলের আকাশে- বাতাসে।
চলবে
0 Comments.