Sat 25 October 2025
Cluster Coding Blog

গল্পেরা জোনাকি তে রীতা চক্রবর্তী

maro news
গল্পেরা জোনাকি তে রীতা চক্রবর্তী

টান

নিজের বিবাহিত সম্পর্ক থেকে বেরোনোর পনেরো বছর পর আজ প্রথম সুধাংশু এসেছিল। শুধু একটাই অনুরোধ করে গেছে - বিউটিকে একটিবার চোখের দেখা দেখবে। বিজয়ার একমাত্র মেয়ে বিউটির জন্মদাতা সুধাংশু'তো কোনোদিন মেয়ের কথা জানতেও চায়নি। তবে আজ কেন মনে পরল এত বছর পর? সেই থেকেই মনটা বড্ড আনচান করছে বিজয়ার। রক্তের টান কি একেই বলে?

ব্যালকনির গায়ে থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা মাধবী লতার গন্ধ সন্ধ্যার বাতাসে স্নিগ্ধ পরশ এনে দিয়েছে। আলো আঁধারিতে একা ইজিচেয়ারে গা'এলিয়ে দিয়ে বিজয়া ভাবছে সেই কথা। মনটা অশান্ত,ঝড় উঠেছে। সেই ঝড়ের হাওয়া ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে অতীতের দিনগুলিতে। ভাবনার পথ ধরে ফেলে আসা দিনগুলির কথা একটু একটু করে মনে পরছে বিজয়ার।

ঠিক এমনই ভীষণ ঝড় উঠেছিল সেদিন বিকেলে। কলেজ থেকে ফিরে সবে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়েছে বিজয়া। হাল্কা কিছু মুখে দিয়েই ছুটতে হবে টিউশন পড়াতে। এখন গিয়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে পেরিয়ে যাবে। একই বাড়ির দুটো বাচ্চাকে পড়ায় বিজয়া। সামান্য যেকটা টাকা পায় তাই দিয়ে নিজের হাতখরচটুকু চালিয়ে নেয়। অবশ্য ওদের পাড়ায় অনেকেই বলে রেখেছেন তাদের বাচ্চাকে পড়ানোর কথা। তবে নিজেকে একটু ফ্রি রাখতেই বেশি টিউশন নিতে চায়না। তাছাড়া বাড়ি ফেরার পথে সন্ধ্যের দিকে অনিমেষ ওকে সাথে করে এগিয়ে দিয়ে যায়। অনিমেষকে তো একটু সময় দিতেই হয়। সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে ওদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যদিও বাড়িতে কাউকে কিছু বলেনি বিজয়া। কারণ অনিমেষ বোনের বিয়ে নাদিয়ে নিজেদের বিয়ের কথা ভাববেনা। তাই এখনই এসব নিয়ে বাড়িতে কথা বলার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। আর আজকাল তো সারাদিন ওর সাথে দেখাই হয়না। এই সন্ধ্যেটুকু ওরা দুজনে দুজনকে একটু কাছে পায়। তাই এটুকু সময় অনিমেষের জন্য রাখা থাকে। বাড়ির বড় ছেলে বলে বাবা মারা যাবার পর সংসারের সব দায়িত্বই অনিমেষের ওপর এসে পরেছে। বোনটা এবার ক্লাস টেন। মার যদিও খুব বয়স হয়নি কিন্তু দেখে বেশ বয়স্ক মনেহয়। সে যাই হোক, বিজয়ারো বিয়ে নিয়ে এত তাড়া নেই। পাশে থাকার, হাতে হাত রেখে ভালোবাসার আনন্দতো কিছু কম নয়। এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বিজয়া খেয়ে উঠে সবে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে শাড়ি পরে রেডি হচ্ছে। হঠাৎই দেখে আকাশের কোনে কালো একটুকরো মেঘ যেন পাহাড় মাথায় নিয়ে ছুটে চলেছে। মুহূর্তে ওঠে তুমুল ঝড়। ওই ঝড়ের মধ্যেই দেখে বাবা ফিরে এসেছেন। বাবা আজ খুব তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন দেখে মা'ও অবাক। আরো অবাক কান্ড হল বাবা হাতে করে চারপাঁচ রকম মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। বিজয়াকে ডেকে ওর বাবা বললেন, তোমার এখন কোথাও যাওয়া হবেনা। আমাদের অফিসের হেডক্লার্ক সুবোধবাবু সপরিবারে আসছেন আমাদের বাড়িতে। ওনারা তোমাকে দেখতে আসছেন। সঙ্গে ওনার ছেলেও আসছে । ছেলেটি উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানিতে চলে যাবে। তার আগে ওঁরা ছেলের বিয়ে দিতে চান। আমাকে খুব করে ধরেছেন তোমার জন্য। তাই না করতে পারিনি। বিজয়ার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল। একদিকে বাবার সম্মান অন্যদিকে নিজের ভালোবাসা। তবে বিজয়া কোনোদিন বাবার অবাধ্য হয়নি। আজও বাবার আদেশে টিউশন পড়াতে যাওয়া হলনা। অবশ্য সেদিনের পর থেকে আর কোনদিনই পড়াতে যাওয়া হয়নি। পরবর্তী পনেরোদিনের মধ্যে অত্যন্ত সাধারণ ভাবে বিজয়ার বিয়ে হয়ে যায় সুধাংশুর সাথে। আগামী ছ'মাস সুধাংশু এদেশেই আছে। তারপর চলে যাবে। প্রথমবার একলাই যাবে। একবছর পরে এসে বিজয়াকে নিয়ে যাবে। এসব কথা অবশ্য বিয়ের আগেই সবার সামনে হয়ে গেছে। সুধাংশু বিদেশ যাবার পর থেকে বিজয়া মায়ের কাছেই আছে। প্রথম প্রথম সপ্তাহে অন্তত দুটো চিঠি লিখত সুধাংশু। খুব সুন্দর করে লিখত সেসব চিঠি। চিঠির প্রতিটি লাইনের প্রতিটি অক্ষর ছিল ভালোবাসায় মাখামাখি। চিঠিতে যে এভাবে পাগলকরা ভালোবাসা থাকতে পারে বিজয়া কখনো ভাবেনি। কিন্তু মাস দুয়েকের মধ্যেই দেখা গেল সপ্তাহে একটাও চিঠি আসেনা আর। এদিকে প্রথম সন্তান হবে বিজয়ার। স্বামীর কথা ভেবে ভেবে শরীর মন খুবই খারাপ হচ্ছে দিনে দিনে। একলা ঘরে দিন কাটানো কষ্টকর হয়ে উঠেছে। বাড়িতে মা ছাড়া কথা বলার মতো কেউ নেই বিজয়ার। তাই মায়ের অনুমতি নিয়ে আবার টিউশন পড়ানো শুরু করে। আবার অনিমেষের সাথে দেখা হয়। এভাবেই একদিন অনিমেষকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসে বিজয়া। তখনই ওদের সম্পর্কের কথা মা'কে জানায়। এদিকে সুধাংশুও আর কোনো যোগাযোগ রাখেনা। অনিমেষ এখন নিয়মিত বিজয়ার ভালো মন্দের খোঁজ খবর রাখে। সব রকম প্রয়োজনে পাশে থাকে। এমনকি বিজয়াকে নার্সিংহোমে ভর্তি করানোর সময়ও একলাই সব সামলেছে। তাই বাড়িতে এখন সবাই অনিমেষকে মেনে নিয়েছে। ফুটফুটে পরীর মতো ছোট্ট একটা মেয়েকে কোলে নিয়ে বিজয়া বাড়িতে এল। কিন্তু মেয়ে হয়েছে শুনে শ্বশুরবাড়ির লোকজনও বিজয়ার খোঁজ খবর নেয়া বন্ধ করে দিল। বাধ্য হয়ে বিজয়া তখন সুধাংশুর কাছ থেকে ডিভোর্স চেয়েছিল। বিবাহ বিচ্ছেদের পর বিজয়ার সব দায়িত্ব নিয়েছে অনিমেষ, অবশ্যই দুই বাড়ির সম্মতিতে। ষোলো বছরের বিউটি এখনও জানে ও অনিমেষের একমাত্র সন্তান।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register