Tue 28 October 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে দীপশিখা দত্ত (পর্ব - ১)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে দীপশিখা দত্ত (পর্ব - ১)

কাকাতুয়া বাড়ী (বাড়ীটা)

ছোটবেলায় আমাদের বাড়ীর পাশে একটা বাড়ী ছিলো, আজ তার কথাই বলবো।যেখানে আজো আমাদের শৈশব- কৈশোর জমা রাখা আছে। ব্রিটিশ আমলের বেশ বড়ো একটা দোতলা বাড়ী। সামনে ছোট্ট একটা সরু রেলিং লাগানো একটা ছোট্ট কাঠের গেট ছিলো। গেট থেকে সদর দরজা পর্যন্ত বিশাল রোয়াকওয়ালা বারান্দা। উঁচু উঁচু কড়িকাঠের ছাদ। বিরাট বড়ো বড়ো শুনশান ঘরগুলোতে কোনো উচ্ছ্বাস নেই, আবেগ নেই - শুধু আছে শিষ্টাচার, সভ্যতার বসত। এবাড়ীতে কেউ উঁচু গলায় কথা বলেনা, কোনো চেঁচামেচি নেই। দুখানা ঘর পেরিয়ে ভেতর বারান্দার পরে উঠোন। উঠোনের একপাশে একটা বিশাল বারোমাস্যা জবা গাছ। গাছময় লালটুকটুকে জবা ফুটতো বারোমাস।ওপাশে ঝাঁকড়া এক টগর গাছ। সারারাত শিশির মেখে ফুল ফুটে সাদা হয়ে থাকতো হেমন্তকালে। ছোট্ট বেলীচারাতেও কত্তো কুঁড়ি আসতো, ফুল ধরতো গ্রীষ্মকালে! উঠোনের কামিনী ফুলের গাছটা গভীর রাতে শ্বেতবসনা হয়ে এতো উন্মত্ত গন্ধ বিলোতো, যে একটা বাড়ী পেরিয়ে আমাদের উঠোনেও রাতদুপুরে গাছটার পাগলামি টের পেয়ে যেতাম। বিশ ইঞ্চির সুড়কির গাঁথনীওয়ালা দেয়ালের ঘরে বড্ডো আরাম হতো গরম কালে। উঠোনের একধারে রান্নাঘর আর ওপাশটায় কলঘর। কলঘরে অবিরাম ক্যান্টনমেন্টের অফুরন্ত জল পড়ে যেতো টিনের বালতি ভরে, সেখানে সিমেন্টের তাকে সাজানো থাকতো মাইসোর স্যান্ডাল সোপ আর অ্যালুমিনিয়ামের ঢাউস স্নানের মগ। দূরে মেরুন রংয়ের কাঠের দরজা লাগানো খাটা পায়খানা। পায়খানার দোরগোড়ায় একখানা তোবড়ানো এ্যলুমিনিয়ামের বদনা। তখনো মানুষ প্লাস্টিকের ব্যবহার শেখেনি। পায়খানার পিছে ছিলো পিছনের দেউড়ী। স্নানঘর সাফ করার জন্য বাড়ীর ভেতর মেথর আসবার রাস্তা। রান্নাঘরে ইঁট পাতা কয়লার উনুনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রান্না করতে হতো। উনুনে আঁচ দিয়ে তালপাতার পাখায় হাওয়া দিতে হতো বসে, কিন্তু রান্না হতো দাঁড়িয়ে। ব্যাপারটা দেখে আর বুঝে ভারী মজা লাগতো আমার। সামনের বড়ো ঘরটা পেরোলেই একপাশ দিয়ে উঠে গেছে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। উঁচু উঁচু চওড়া সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করতে আমরা সেই ছোটবয়সেই হাঁপিয়ে যেতাম। চওড়া সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় দেওয়ালের পাশে দেখতাম ছোট্ট ছোট্ট কুলুঙ্গী। শুনেছিলাম, ব্রিটিশ আমলের মুসলিম আর্দালীদের ওই বাড়ীগুলোতে বিজলীবাতি চলে গেলে কুলুঙ্গি তে সেঝবাতি রাখা হতো। দোতলাতেও অনেক বড়ো বড়ো চকমিলানো ঘর ছিলো। বিশাল বড়ো বড়ো খড়খড়ি লাগানো জানলা। খড়খড়ি নামালেই জানলার ফাঁক দিয়ে রাস্তা দেখতে পেতাম আমরা। জানলার ভেতরের দিকে লাল সিমেন্টের তৈরী চওড়া চওড়া বসার জায়গা। দোতলাতেও ভিতরবাড়ীতে সুন্দর টবে লাগানো একটা ছাদবাগান ছিলো। ওই ছাদবাগানেই হাতে ধরে পুঁচকি মেয়েটাকে বড়জেঠু একনিষ্ঠ শিষ্যের মতো একের পর এক চিনিয়ে দিতেন দোপাটি, নয়নতারা, মাইকফুল, ঝুমকো লতা,কাগজফুল, অমলতাস ফুলের গাছগুলোকে। ঘরের বড়োবড়ো দেয়ালগুলোতে টাঙ্গানো ছিলো অনেক ছবি। পূবের দরজার ঠিক মাথার ওপরে ছিলো মা কালীর একখানা ছবি, সাথে ঠাকুর আর মা বসে আছেন ধ্যানরত অবস্থায়। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,নেতাজী,স্বামীজি, গান্ধীজী,নেহেরুর ছবি। দিদুর ঠাকুরঘর ছিলো কাঠের দেওয়াল আলমারীর ভেতরে।বাড়ীটার বৈঠকখানায় দুখানা বেশ বড়োঘর নিয়ে গড়ে উঠেছিলো অবাঙালী পাড়ার একমাত্র বাংলা লাইব্রেরী "রবীন্দ্র পাঠাগার"।একদিন বাদে বাদে ওখানে বই বদলে দেওয়া হতো। আমার মায়ের খুব গল্পের বই পড়ার নেশা ছিলো,একটু বড়ো হতেই আমিও সেই একই নেশাসক্ত হয়ে পড়ি,সেকথায় আসবো পরে। আমি ওখানে নিত্য বই বদলাতে যেতাম। কাকাতুয়া বাড়ীটার মালিক ছিলেন ঁশ্রীযুক্ত যোগীন্দ্রনাথ ঘোষ। ওনাকে আমি জীবিত দেখিনি। ওঁর স্ত্রী ছিলেন ফর্সা তুলতুলে, ছোট্টখাটো এক মিষ্টি মহিলা, আমরা ডাকতাম 'দিদু' বলে। ঘটিহাতা সাদা শেমিজের সাথে, সাদা ধবধবে থান আটপৌরে ভাবে পড়তেন বারোমাস। দিদুর সন্তান সংখ্যা ছিলো,পাঁচ। দুই মেয়ে- হাসি আর পুষ্প; আর তিন ছেলে- বিমল, সুশীল আর সুনীল। দুই মেয়ের বিয়ে, আমারো জন্মের আগে হয়েছিলো - পুষ্প ছিলেন ব্যারাকপুরের ডাকসাইটে বর্ধিষ্ণু ঘোষবাড়ীর বউ আর হাসির বিয়ে হয়েছিল ডিব্রুগড়ে। আমি তখনো জানতাম না ডিব্রুগড় ঠিক কতদূরে! তিনছেলেই ছিলেন চরম মাতৃভক্ত ও অকৃতদার। ছেলেরা পর হয়ে যাবে বলে মা কোনোদিনই ছেলেদের বিয়ের কথা ভাবেননি আর ছেলেরাও এই প্রসঙ্গ উত্থাপনের তাগিদ কখনো অনুভব করেনি। আমরা দিদুর মেয়েদের ডাকতাম হাসি পিসীমা আর পুষ্প পিসীমা বলে আর ওনার ছেলেদের বড়োজেঠু, মেজোজেঠু আর ছোটোজেঠু বলে। ও হ্যাঁ! ওই বাড়ীতে আরো একজন সদস্য ছিলো, পায়ে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা, দাঁড়ে বসে থাকা একটা সাদা ধবধবে বুড়ো কাকাতুয়া। কাউকে দেখলেই কাকাতুয়াটা হলদে ঝুঁটি তুলে ক্যাঁ ক্যাঁ করে চিৎকার করে বাড়ী মাথায় করতো। দিদু বলতেন, "ওর বয়স হয়েছে,ওর গলায় ফোঁড়া আছে তাই ও কথা কইতে পারে না। কিন্তু ও সবকিছু বুঝতে পারে।" আমাদের হাঁটতে শেখার কিছুদিন পর থেকেই কাকাতুয়া বাড়ীতে আসা যাওয়া। যখন তখন চলে যেতাম। কে যে প্রথম আমাদের ওইবাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিল আজ আর মনে নেই। ওইবাড়ীতে আমাদের সমবয়সী কেউ ছিলো না, তবুও কি জানি, কিসের নেশায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাকাতুয়া বাড়ীতে আমরা যখন তখন আসা যাওয়া করতাম। ওই সাজানো, গোছানো হৈ হট্টগোলবিহীন বিশাল বাড়ীটা আমাকে টানতো। আমার শিশু মনের কল্পনায় নিশিডাকের রাজপ্রাসাদ মনে হতো বাড়ীটাকে।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register