Tue 28 October 2025
Cluster Coding Blog

গল্পেরা জোনাকি তে রীতা পাল (ছোট গল্প সিরিজ)

maro news
গল্পেরা জোনাকি তে রীতা পাল (ছোট গল্প সিরিজ)

অভিমান

হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই রাই মুঠোফোনটা বের করল। অনেকগুলো মিস কল। ডাক্তার বাবুর সাথে কথা বলছিল বলে ফোনটা সাইলেন্ট রেখেছিল। সব আত্মীয়- স্বজনদের ফোন। তার মধ্যে কেকার ফোনও রয়েছে। ফোনটা ব্যাগে রেখে বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল। বাসে উঠে জানালার ধারে একটা সিট পেয়ে বসে পরলো। ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করে কেকাকে ফোন করলো। কেকা,“ কিরে কোথায় ছিলি? ফোন ধরলি না তো।” রাই, “ আর বলিস না! শ্বশুরমশাই ক’দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তাই ভিজিটিং-র পর ডাক্তার বাবুর সাথে কথা বলছিলাম। ” কেকা,“ কি হয়েছে ওনার? তুই পারিস ও বাবা! সারথিদা নিশ্চয়ই নেই!” রাই, “ ডাক্তার তো বললেন ওনার ইউরিন ইনফেকশন হয়েছে। বয়স হয়েছে তো। না রে,ও তো অফিসের ট্যুরে বাইরে গেছে। বল কেন ফোন করেছিলিস?” কেকা,“ অফিসের ট্যুরে বাইরে না কাউকে নিয়ে আউটিং এ। দিব্য আছে সব ঝামেলা তোর ঘাড়ে ফেলে। বয়স্ক বাবা-মা,ছি লজ্জাও করে না! যার জন্য ফোন করেছিলাম বলে আর লাভ নেই। কালকে নন্দনে ‘কারুবাসনা’ মঞ্চস্থ হবে। ভেবেছিলাম দু’জনে দেখব। আর কি করে হবে। তুমি সেবা করে যাও?” রাই,“ সবই আমার ভাগ্য বুঝলি। তাই তো সব দোষ ভাগ্যচক্রকে দিই। হয়তো একদিন চাকাটা ঘুরবে। সেদিন বুঝতে পারবে। যাক সেসব,তুই কাউকে নিয়ে দেখে নে। এবার আর আমার হবে না। রাখলাম”। বাড়িতে এসে জামা কাপড় ছেড়ে সানার ঘরে ঢুকলো। সানা হোমওয়ার্ক করছে। রাই আর সারথির ১০ বছরের মেয়ে। মাকে দেখে বলে উঠল,“ মা দাদান কেমন আছে?” রাই“ আজ ভালো আছে। আরো দুদিন অবজারভেশনে রাখবে। তারপর ছেড়ে দেবে। “তুমি কিছু খেয়েছো? মাসিকে বল একটু ম্যাগি বানিয়ে দিতে। এরপর তো টিচার এসে যাবে তখন আর খেতে পারবে না।” মন্দিরে শঙ্খ বেজে উঠল। সন্ধারতি শুরু হবে। রাই গুটিগুটি পায়ে মন্দিরের দিকে এগোলো। প্রভাদেবী একদৃষ্টে রাধামাধবের দিকে চেয়ে বসে আছেন। রাই শাশুড়ি মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। শাশুড়ি মা ছলছল চোখে রাই এর দিকে তাকালেন তারপর আবার ঠাকুরের দিকে চেয়ে রইলেন। সন্ধ্যারতি শেষ হলো। ঠাকুরমশাই পঞ্চপ্রদীপ নিয়ে এলেন। প্রভাদেবী আরতির শিখা স্পর্শ করে আগে বৌমার মাথায় দিলেন তারপর নিজের মাথায় নিলেন। রাইকে জিজ্ঞাসা করলেন,“ ও কেমন আছে?” রাই,“ এখন ভালো আছে। দুদিন পরেই ছেড়ে দেবে।” প্রভাদেবী হাতের মুঠো খুলে একটা কাঞ্চন ফুল দিয়ে বললেন,“ এটা কাল যখন যাবে নিয়ে যেও। ওর মাথায় একটু বুলিয়ে দিও। তুমি যাও। আমি ঠাকুরমশাইকে সব বলে দিয়েছি। উনি সব গুছিয়ে তারপর যাবেন।” রাই রাধামাধবকে প্রণাম করে উঠোনে নামতেই চোখে পড়ল টলটলে জ্যোৎস্নায় চাঁদ ভাসছে। তবে তো পূর্ণিমার আর বেশি দেরি নেই। পূর্ণিমায় রাধামাধবকে ভোগ দেওয়া হয়। সেদিন অনেক কাজ,ভাবতে-ভাবতে নিজের ঘরের দিকে এগোলো রাই। রাতে মেয়েকে খেতে দিয়ে নিজে খেতে বসতেই গা’টা কেমন গুলিয়ে উঠলো। খেতে পারল না। আজ হাসপাতাল থেকে বেরনোর পরেই শরীরটা কেমন লাগছিল। রাতে শুয়ে ঘুম আসছিল না। কেকার কথাটা কানে বাজছিল। কেকা মিথ্যা বলিনি। সারথীর এই এক দোষ। অবশ্য ওর একারই বা দোষ কি? নিজেদের স্বামী সন্তান ছেড়ে অফিসের বসের সঙ্গে দিব্বি আউটিং এ চলে যায় যেসব মেয়েরা তাদের নামের আগে কি বিশেষন হওয়া উচিত,তা আজও রাই বুঝতে পারে না। বনেদি ফ্যামিলি দেখে বাবা মা বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ে হবার দু'বছর পর সানা হয়। স্বামী সন্তান সংসার নিয়ে রাই এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে সারথির চালাকিগুলো বুঝতেই পারেনি। অফিস ট্যুরের নাম করে কোথায় রাত কাটায় তা একদিন স্পষ্ট হয়ে যায়। সন্দেহ ক্যান্সার এর চেয়েও ভয়ঙ্কর রোগ। এর যন্ত্রণা প্রতিমুহূর্তে কুরে কুরে খায়। এই ইন্টারনেটের যুগে ইনবক্সটা যতটা গোপন পৃথিবীটা তার থেকে অনেক বেশি খোলা। অজস্র চোখ পর্দার আড়ালে ইকিরমিকির খেলে চলেছে। সানার বয়স যখন তিন বছর তখন রাই একটু সময় বার করেছিল নিজেকে দেখার। অনেকদিন পর ফেসবুকটা খুলেই কেকাকে পেয়ে গেল। খুব আনন্দ। সেই ছোটবেলার বন্ধু। একই স্কুল-কলেজ। তারপর কেকা ম্যানেজমেন্ট পড়তে ব্যাঙ্গালোরে চলে যায়।রাই এর বিয়ে হয়ে যায়। সময় নিজের মত বয়ে যায়। তারপর আবার এই নেটদুনিয়ায় দেখা। কেকা ভালো চাকরি করে তবে বিয়ে করেনি। লিভিং এ আছে। বিয়ের কথা বললেই বলে,'তুইতো বিয়ে করেছিস,কি পেয়েছিস?' ওকে বোঝানো যায় না। সব হিসেব নিজস্ব তুলাদণ্ডে মাপা যায় না। হয়তো ওই ঠিক। আমি ভুল। আমি সুখের ক’টা দিন নিয়ে একটা দুঃখের সমুদ্রে ভেসে থাকার চেষ্টা করছি। এটাও তো জীবন। ' প্রথম যেদিন সারথি ট্যুর থেকে ফেরার পর ওর ব্যাগে কন্ডম পেয়েছিল রাই সেদিন ভেবেছিল,এটা কি শুধুই ভুল না ইচ্ছাকৃত ভুল। যতদিন যাচ্ছিল সারথির ব্যবহার পাল্টাচ্ছিল। একটা মিথ্যে লুকাতে হাজারটা মিথ্যা বলছিল। ও ক্লান্ত হলো না।ওদের সম্পর্কটা আস্তে আস্তে ক্ষত বিক্ষত হয়ে হিমঘরে চলে গেল।

আজ ও মনে পড়ে এক পূর্ণিমা সন্ধ্যায় কেকা ফোন করেছিল ,' কিরে কি করছিস?,' এইতো সন্ধ্যা আরতির জোগাড় করছি। তুই কোথায় ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি? ' ' আমি তো দীঘাতে। একটা কনফারেন্সে এসেছি। সারথিদা কোথায়?'.' বললাম ও তো অফিসের কাজে বাইরে গেছে।' ও সারথির বেসকিছু ছবি পাঠাল। বলল, ' আমার হোটেলেই আছে। সাথে মেয়েটি কেরে? দুপুরে সুইমিং পুল সাইডের জানলা দিয়ে দুজনকে দেখলাম ।কায়দা করে হোটেল এর ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করতে , 'জানাল যে উনি মাঝে মাঝেই এখানে আসেন। তুই কিছু জানিস না? রাই,' না ' হিমঘরের দরজাটা কে যেন ধাক্কা দিয়ে চিরদিনের মত বন্ধ করে দিল।' তুই ফোনটা রাখ। আমার পূজার সময় হয়ে গেছে'। রাস্তার কুকুরগুলো আজ বড্ড চেঁচাচ্ছে। কিছুতেই ঘুম আসছে না। পুরনো স্মৃতিগুলো বড্ড যন্ত্রনা দেয়। মাথাটা কেমন যন্ত্রণা করছে। গা’টা গুলাচ্ছে? বাথরুমে গিয়ে খানিকটা বমি করার চেষ্টা করল বমি হল না। কিন্তু ভেতর থেকে একটা ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ফ্যানটা বাড়িয়ে দিয়ে চোখ বোঝানোর চেষ্টা করলো। সকালবেলা গা’টা কেমন ম্যাজম্যাজ করছিল। স্নান করতে শীত শীত লাগছিল। এদিকে ফোনটা বেজেই চলেছে। তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে হাসপাতলে ফোন করল। রিসেপশনিস্ট জানালেন, "উনি ভালো আছেন। ভিজিটিং আওরে আসলেই হবে।" রান্নাঘরে রান্নার দিদিকে সব বুঝিয়ে দিল। মেয়ের টিফিন করে রেডি করল। সানাকে বলল, " মামনি আজ আমি আর বাসে তুলতে যাচ্ছি না। তুমি চলে যাও। আমার শরীরটা ভালো নেই।" সানা ঘাড় নেড়ে বলল," ঠিক আছে মা।" তুমি একটু রেস্ট নাও।" রাই দোতালার বারান্দা দিয়ে দেখছিল মেয়ের স্কুলের বাসটা চলে যাচ্ছে। ভাবছে কতদিন পর অসুস্থ পৃথিবীটা আবার ছন্দে ফিরেছে। বাসটা চলে যেতেই। বড্ড ক্লান্ত লাগল।কনোরকমে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। একটু চোখ বুজে এসেছিল ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। সারথির ফোন। “ বাবা কেমন আছে? তুমি ও দিকটা একটু সামলে নাও আমি দুদিন পরেই ফিরে যাব ” বলেই ফোনটা রেখে দিল। রাই ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইল। একটা মুহূর্তে সব দায়ভার কেমন ঝেড়ে ফেলা যায় এই ফোনটা তার প্রমাণ। গলাটা কেমন খুসখুস করছে। শরীরটা কেমন অস্হির অস্হির করছে। দুপুরে খেতেও পারল না।মাথাটা ভার হয়ে আছে। না বেরালেও নয়। বিকালে হাসপাতালে গিয়ে শুনল বাবার ছুটি হয়ে গেছে। ওনাকে বাড়ি নিয়ে আসতে হবে। সাতদিন পর আবার একবার চেক আপ। ডাক্তারের সাথে কথা বলে বেরোনোর সময় মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। কোনো রকমে নিজেকে সামলে বাবার জিনিসপত্র ও বাবাকে নিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরল। বাড়িতে পৌঁছে দেখলো গেটের সামনে মা দাঁড়িয়ে আছেন। বাবাকে নিয়ে ভেতরের ঘরে গেলেন। সবার অলক্ষ্যে রাই নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সন্ধ্যা বেলা থেকে ধুম জ্বর। মেয়ে ফোন করে পাড়ার এক ডাক্তারবাবুকে ডাকলো। ডাক্তার দেখেই করোনা টেস্ট করতে বলল। মেয়েকে দাদু দিদার কাছে রেখে রাই ঘরের দরজা দিল। আজ খুব একা লাগছে। সব দুঃখ মেয়েকে নিয়ে ভুলে ছিল। একদিনও মেয়ে ছাড়া থাকেনি। আজ মেয়ে তার কাছে নেই। সবাই এমন ভয় পেল যে রাতে ধারে কাছে কেউ এলো না। ৭২ঘন্টা পর রিপোর্ট এলো করোনা পজেটিভ। তখন রাই এর সাংঘাতিক শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সারথিও ফেরেনি। শেষে মেয়ে কেকা মাসি কে ফোন করল। “ হুম,বল।” “ আমি সানা,মায়ের খুব শরীর খারাপ। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। করোনা হয়েছে। তুমি একটা ব্যবস্থা করে দাও হাসপাতালে।” কান্নায় ভেঙে পড়েছে সানা। “তোরা আমাকে আগে বলিস নি কেন? তুই রাখ,আমি দেখেছি ।”

যত সময় যাচ্ছে রাই এর অবস্থার অবনতি হচ্ছে। অনেক চেষ্টার পর হাসপাতালে একটা বেড জোগাড় হল কিন্তু অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। সারথি কে অনেক ফোন করেও পোল না কেকা। সুইচ অফ। সব কেকাকেই করতে হল। কেকার ড্রাইভার নীলুদা খুব ভালো মানুষ। নিজই কেকাকে বললো, "দিদি তুমি বাড়িতে যাও একটু রেস্ট নাও রাতে এখানে আমি থাকছি।" কেকা অবাক হয়ে নিলুদা কে দেখছে। আজ ঘরের মানুষ কতটা পর আর পর কতটা আপন। কেকারও মনে হল একটু ফ্রেস হওয়া দরকার। একটা ওলা বুক করে বাড়ি ফিরল। সানাকে ফোন করে বলল, "দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে। " ভোরবেলা কেকার চোখটা একটু লেগে এসেছিল রিংটোন বাজতেই দেখল হাসপাতালের নম্বর। ফোনটা ধরে কেকা একদম স্থির হয়ে গেল। সানার মুখটা ভেসে উঠলো। মনে মনে বলে উঠল, রাই,তুই খুব সেলফিস রে। মেয়েটার কথাও ভাবলি না। এত অভিমান তোর। জালনার সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটা ফুলে লাল হয়ে আছে। জানলার সামনে গিয়ে নিচের দিকে তাকালো। দেখল,আবছায়ায় একটা ছোট্ট মেয়ে এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতে দিগন্তের দিকে হেঁটে চলেছে। কেকা চিৎকার করছে অথচ অথচ গলা থেকে একটাও শব্দ বের হচ্ছে না। কেকা চিৎকার করে,“ রাই, দাঁড়া রাই,আমরা আবার একসাথে কিতকিত খেলব। রাই---রাই।”

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register