Mon 27 October 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব - ৩৫)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব - ৩৫)

কলকাতার ছড়া

আজকের তিলোত্তমা। সাজানো গোছানো ভিড়ে ঠাসা আমাদের শহর। কিন্তু একটু নাড়াচাড়া করে দেখলেই বর্ণময় ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের বহু রং। আদ্যোপান্ত ইংরেজ সাহেবদের হাতে তৈরি একটা শহর। ভারতবর্ষের অন্যান্য শহরের সমৃদ্ধ ইতিহাস থাকলেও একক ভাবে ব্রিটিশ কলোনিয়াল ধারা জুড়ে রয়েছে আমাদের এই শহরের আনাচেকানাচেই। আজও এই শহরে পাওয়া যায় ক্যানিং স্ট্রিট, ল্যান্সডাউন রোড, ডালহৌসি স্কোয়ার। সুতরাং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ছায়ায় মোড়া কলকাতায় আজও লেগে আছে লালমুখো সাহেব সাহেব গন্ধ। কিন্তু রোজকার ব্যস্ত হেঁটে চলা বাঙালি কি তাকিয়ে দেখছে সেই ইটগুলোর দিকে? ইতিহাস চাপা পড়বার জিনিস নয়। পড়েও না। তাকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হয় আজকের প্রজন্মকে। কিন্তু নতুন বিদেশী শাসকরা এদেশে আসবার পরে ঠিক কেমন ছিল এদেশের মানুষগুলোর দৈনন্দিন জীবনযাপন। তখন কথায় কথায় ফাঁসি দেওয়ায় তারা ছিল সিদ্ধহস্ত। সে যেকোনো অপরাধই হোক না কেন। এমনকি জনসমক্ষে ফাঁসি প্রদর্শনের জন্য রাস্তায় গাছের নীচে তৈরি থাকতো ফাঁসির মঞ্চ। অর্থাৎ প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড। যাতে মানুষজনকে প্রকাশ্যে মৃত্যু দেখিয়ে ভয়ের সঞ্চার করা যায়। বর্তমানে রাজভবনের কাছে ফ্যান্সি লেন কলকাতার এক পরিচিত গলি। আজকের কলকাতাবাসী যতই এই নামটি অভিজাত ভঙ্গিতে উচ্চারণ করুন না কেন, আসলে এই নামের উৎস খুঁজতে গেলে চমকে উঠতে হয় বৈকি। সেই রাস্তাতেই নাকি ছিল এমন একটি ফাঁসির মঞ্চ। আর 'ফাঁসি'ই ইংরেজি অপভ্রংশে হল 'ফ্যান্সি'। যেখানে সামান্য ঘড়ি চুরির অপরাধে ফাঁসি দেওয়া হয় এক জনৈক দেশীয় কর্মচারীকে। কলকাতার মানুষের কাছে এই রাস্তা ছিল এক জ্বলন্ত বিভীষিকা। কেউ দিনের আলোতেও ঢুকতে চাইত না সে তল্লাটে। লম্বা রাস্তা। দুধারে সারবদ্ধ গাছ। আর তার মাঝেই গাছের ঢালে প্রকাশ্য ফাঁসির আয়োজন। শহরে আসার একদম প্রথম দিকে কোনো এক জনৈক দস্যুর বা ডাকাতের ফাঁসির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয় এই রাস্তার পরিচিতি। বাকিটা রয়ে গেছে আতঙ্ক আর ভয়ার্ত ইতিহাসের গল্পে। যদিও আজ গল্প হলেও তা একেবারে জীবন্ত সত্য। তখন কলকাতায় বিভিন্ন দিকে প্রকাশ্যেই চলত শাস্তিদানের ব্যবস্থা। প্রসঙ্গত বলি। মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি মনে আছে নিশ্চয়? কলকাতার ইতিহাসে সে এক কালো অধ্যায়। চাকরিসূত্রে তিনি ছিলেন কোম্পানীর দেওয়ান। হুগলী, নদীয়া ও বর্ধমান অঞ্চলে দেওয়ানি সামলেছিলেন বহুদিন। তাও আবার স্বয়ং ওয়ারেন হেস্টিংসের বদলি হিসাবে। এই অপমান কখনোই ভুলতে পারেন নি হেস্টিংস সাহেব। এরপর থেকে কখনোই আর দুজনের সম্পর্কে শীতলতা ফিরে আসেনি কোনোভাবে। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের লড়াই অব্যাহত রেখেই দুই প্রভাবসম্পন্ন ব্যক্তির দ্বন্দ্ব কলকাতাবাসী প্রত্যক্ষ করেছে সেইযুগে। নবাব মীরজাফরের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র মোবারক-উদ-দৌলার অবিভাবকত্বের আর্জিতে মুন্নি বেগমের থেকে অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ ওঠে হেস্টিংসের বিরুদ্ধে। আর ঘটনাচক্রে অভিযোগটি আনেন মহারাজা নন্দকুমার। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পে (যাঁর কবর আজও সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে দেখা যায়) তাঁর বাল্যবন্ধু হওয়ায় সবটাই যায় নন্দকুমারের বিপরীতে। আর ফল হয় মিথ্যে জালিয়াতির অভিযোগে প্রকাশ্যে ফাঁসি। বর্তমান খিদিরপুরে গঙ্গার ধারে নিজেই নিজের মৃত্যুর স্থান নির্বাচন করেন রাজা। গঙ্গাকে আর অসংখ্য দেশবাসীকে সাক্ষী রেখে ফাঁসির দড়ি গলায় বরণ করেন নন্দকুমার। ব্রাহ্মণের মৃত্যু চোখের সামনে দেখে ব্রহ্মহত্যার অভিশাপ থেকে বাঁচতে সেদিন দলে দলে গঙ্গাস্নান করে বাড়ি ফিরেছিল মানুষজন। ঠিক তেমন ভাবেই ফ্যান্সি লেনও সাক্ষী এমন বহু রাজনৈতিক ও স্বার্থের সংঘাতের। যার ফলাফল প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড। ফ্যান্সি অর্থে আধুনিক নয়, ফাঁসির অপভ্রংশ। ঠিক যেভাবে কাঁথি হল কন্টাই, অথবা চুঁচুড়া হল চিনসূড়া। গলির মুখটায় ঢুকলে আজ আর নেই ফাঁসিকাঠ, নেই মৃতদেহ ধারণ করে রাখা গাছের ডালে ঝোলানো দড়ি। কিন্তু রয়ে গেছে জীবন্ত ইতিহাস আর কলোনিয়াল চক্রান্তের শিকার হয়ে অকালে ঝরে যাওয়া বহু ভারতীয় মানুষের কান্না।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register