Mon 27 October 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে রূপক সান্যাল (পর্ব - ৩)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে রূপক সান্যাল (পর্ব - ৩)

দখল

নভেম্বরের শেষ, যদিও শীত এখনো তেমন পড়েনি। রোদেরও বেশ তাপ। দোতলার ব্যালকনিতে রোদ বাঁচিয়ে হুইল চেয়ারে বসে আছে মণীশ, একা। পায়ের ওপর একটা চাদর দিয়ে ঢাকা দেওয়া,ঠান্ডার জন্য নয়,তার পঙ্গু পা’দুটো লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার জন্য। মানুষ তো এভাবেই বেঁচে থাকে, সমস্ত অক্ষমতা আর পঙ্গুত্বকে আড়াল করে, মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে। যদিও মণীশের ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ধপাধাপ সিঁড়িগুলো বেয়ে নিচে নেমে যেতে। ইচ্ছে করছে সব কাজ নিজে দেখাশোনা করতে। আজ তাদের বউভাত। ক্যাটারার এখনো এসে পৌঁছয়নি,টুনিবাল্বগুলো অর্ধেক লাগিয়ে কোথায় যে চলে গেল ছেলেটা,প্রায় একঘণ্টা হতে চললো। এত লোক আজ বাড়িতে,সবাইকে সে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আপ্যায়ন করতে চায়। কিন্তু তখনই হাত ঠেকে যায় হুইল চেয়ারের মস্ত চাকায়। মণীশ দুইহাত মুঠো করে সজোরে ঘুঁষি মারে চাকা দু’টোর ওপর। রবারের শক্ত চাকা তার মুঠো করা হাত দু’টোকে দ্বিগুন বেগে ফিরিয়ে দেয়। মণীশের চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো কি? বোঝা গেল না। এখনও মণীশের সম্পুর্ন মন জুড়ে আছে শুধু মনিকর্ণিকা। কিন্তু তাকে আর ফিরে পাবার আশা নেই। সে এখন অন্য কারো ঘরনী। মণীশ ভালো রোজগেরে নয় বলে আগে থেকেই কিছুটা ব্যাকফুটে ছিল মনিকর্ণিকা। তবুও একটু আশা ছিল,যদি বাবাকে শেষমেশ রাজি করানো যায়। কিন্তু মণীশের এ্যাক্সিডেন্টের পর বাবা আর মা দু’জনের যৌথ বিরোধিতার সামনে পড়ে হার স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলো মণিকর্ণিকা। বিয়ে করতেই হলো বাপ-মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে। আর এদিকে মণীশের ঘরে বউ হয়ে এসেছে সৌমিলি,মণীশ যাকে এক কাণাও ভালোবাসেনি কোনদিন, ভালো করে দেখেনি পর্যন্ত। সেই সৌমিলি’র প্রতি মণীশের এখন অশেষ কৃতজ্ঞতা। সে’ই এখন তার একমাত্র ত্রাতা। স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে মণীশের সম্পুর্ন দায়িত্ব নিয়েছে সৌমিলি,স্বামীত্বে বরণ করেছে তাকে। এমন মেয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকবে না? একঘর লোক, হাসি মস্করা ইয়ার্কি ফিসফাস,ইঙ্গিতপূর্ণ চোখের দৃষ্টি সবার। মাঝখানে সৌমিলি,নতুন একটা বেনারসী পরা — সাজগোজে পরিপাটি। তার পাশে হুইলচেয়ারে মণীশ। একটি মেয়ে এসে একটা বড় কাঁসার থালা তুলে দিল মণীশের হাতে। তাতে একটা শাড়ি, সিঁদুর কৌটো,মিষ্টির একটা বাক্স,আরো জিনিস সাজানো। মেয়েটি মণীশের কানে কানে কী যেন বললো ফিস ফিস করে,তারপর হেসে গড়িয়ে পড়লো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আর একজন মহিলার গায়ের ওপর। হাসতে হয়,হাসা উচিত— মণীশও তাই কষ্ট করে একটু হাসলো। বড় কাঁসার থালাটা মণীশ সৌমিলি’র হাতে তুলে দিলো। দু’হাত বাড়িয়ে সৌমিলি গ্রহণ করলো সেটা। মণীশ মিনমিন করে বললো, “আজ থেকে আমি তোমার ...” মণীশের গালে কে যেন কষে একটা চড় মারলো। ঘরের মধ্যে কেউ যেন চিৎকার করে বলে উঠলো,“যার নিজস্ব কোন আয় নেই,যে নিজের দু’টো পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে না,সে নিচ্ছে আর একজনের খাওয়া পরা’র দায়িত্ব! বিশ্রী সুরে হাসতে থাকে সেই অদৃশ্য কেউ। মণীশ মাথা নিচু করে। আচার অনুষ্ঠান শেষ হলে সে আবার হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে ব্যালকনিতে চলে এলো। আবার ভাবনায় তলিয়ে গেলো। ভাবা ছাড়া আর কিছুই যে করার নেই তার। একটা রহস্যের জাল ছিড়তে চেষ্টা করে মণীশ। গভীর রহস্য,অংক যেন কিছুতেই মেলে না মণীশের। সৌমিলি হঠাত্‍ মণীশের ওপর এত উদার হয়ে উঠলো কেন? সে কি তাকে ভালোবাসে? কই,কোনদিন বলেনি তো?এতোটাই ভালোবাসে যে,সে পঙ্গু হওয়া সত্বেও তাকে সে একেবারে বিয়ে করতে পর্যন্ত রাজি হলো! এই রহস্যের কুলকিনারা মণীশ করতে পারেনি এখনো। সে মন দিয়েছে মণিকর্ণিকাকে,যে মন একজনকে দেওয়া হয়ে গেছে,তা কি ফিরিয়ে নিয়ে আবার অন্য কারুকে দেওয়া যায়? তা কি সম্ভব? জানে না মণীশ। এসব জানার মত মনের অবস্থাও নেই মণীশের। একদিকে মনিকর্ণিকার প্রতি ভালোবাসা,অন্য দিকে সৌমিলি’র প্রতি এক অদ্ভুত কৃতজ্ঞতা,এই দুই পরস্পর বিরোধী প্রবল ঢেউ মুখোমুখী আছড়ে পড়ে মণীশের মাথার ভেতর। সে আর ভাবতে পারে না। হুইল চেয়ারে বসেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে সে। ঘুম ভাঙলো সৌমিলির ডাকে,“কী গো, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি, শরীর খারাপ লাগছে? ... চলো, সবাই অপেক্ষা করছে, খেতে দিয়েছে তো ...” ক্রমশ....
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register